প্রশ্নঃ কালী ও কৃষ্ণ কি এক

 



  • উত্তরঃ না। কালী ও কৃষ্ণ এক নয়। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত কারণের পরম কারণ পরমেশ্বর ভগবান। তাঁর অনন্ত শক্তি রয়েছে। তার মধ্যে তাঁর বহিরঙ্গা শক্তি মহামায়া দুর্গার একটি উগ্র প্রকাশ হচ্ছেন দেবী কালী।

    জড় বিশ্বের সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় সাধনকারীণী দুর্গা ভগবানের ইচ্ছা অনুসারে পরিচালিত হন। (ব্রহ্মসংহিতা) শ্রীকৃষ্ণ একমাত্র প্রভু, আর সকলেই তাঁর ভৃত্য মাত্র।

    একলে ঈশ্বর কৃষ্ণ, আর সব ভৃত্য।
    যারে যৈছে নাচায়, সে তৈছে করে নৃত্য॥
    (চৈঃ চঃ আদি ৫/১৪২)


    ব্রহ্মা, শিব, দুর্গা, কালী-সকলেই শ্রীকৃষ্ণের ভৃত্য। কালী ও কৃষ্ণ কখনই এক নয়। শাস্ত্রে ভগবানের বহিরঙ্গা মায়াকে অন্ধকারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে-

    কৃষ্ণ-সূর্যসম, মায়া হয়-অন্ধকার।
    যাহা কৃষ্ণ, তাহা নাহি মায়ার অধিকার॥
    (চৈঃ চঃ মধ্য ২২/৩১)

    আলো ও অন্ধকার-দুটি বিপরীত বিষয়। আলোর আবির্ভাবে যেমন অন্ধকার বিদূরিত হয়, তেমনই কৃষ্ণভক্তি হৃদয়ে জাগ্রত হলে মায়ার বৈভবের প্রতি আগ্রহ দূর হয়। কৃষ্ণভক্তি ছাড়া মানুষের বুদ্ধি বিশুদ্ধ নয়।
    "বস্তুতঃ বুদ্ধি 'শুদ্ধ' নহে কৃষ্ণভক্তি বিনে॥"
    (চৈঃ চঃ মধ্য ২২/২৯)


    যখনই জীব কৃষ্ণভক্তি বিমুখ হয়, শ্রীকৃষ্ণের নিত্য দাসত্ব ভুলে যায়, তখনই বহিরঙ্গা মায়াদেবী সেই জীবকে নানা প্রকারে প্রলুব্ধ ও বিমোহিত করে তাকে ত্রিতাপ-দুঃখ দিয়ে এই জন্ম-মৃত্যুর ভবচক্রে বেঁধে রাখেন। যার ফলে বদ্ধ জীবের পক্ষে ভোগবাসনারূপ মায়িক শৃঙ্খলের বন্ধন থেকে ত্রাণ পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    "কৃষ্ণ-নিত্যদাস'--জীব তাহা ভুলি' গেল।
    এই দোষে মায়া তারে গলায় বান্ধিল॥
    (চৈঃ চঃ মধ্য ২২/২৪)


    কিন্তু, সে যদি মায়াদেবীর এরূপ ক্লেশপূর্ণ‌ সংসারে আবর্তিত হতে না চায়, তবে তাকে অবশ্যই শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে প্রপত্তি স্বীকার করতে হবে। তাই শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন--

    মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে।

যারা আমার চরণে প্রপত্তি স্বীকার করে, তারা এই মায়ার কবল থেকে রেহাই পেতে পারবে। (গীতা ৭/১৪)

কিন্তু মায়া যাদের জ্ঞান বুদ্ধি হরণ করেছেন তারা কৃষ্ণভক্ত হতে চায় না। শ্রীঅর্জুনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, চার ধরনের মানুষ আছে যারা কৃষ্ণভজন করে না।

ন মাং দুষ্কৃতিনো মুঢ়াঃ প্রপদ্যন্তে নরাধমাঃ।
মায়য়াপহৃতজ্ঞানা আসুরং ভাবমাশ্রিতাঃ॥


অর্থাৎ মূঢ়, নরাধম, মায়ার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে এবং যারা আসুরিক ভাবাপন্না, সেই সমস্ত দুষ্কৃতকারীরা কখনও আমার (শ্রীকৃষ্ণের) শরণাগত হয় না।" (গীতা ৭/১৫)

মহামায়ার সংসারে নানাবিধ ভোগবাসনা চরিতার্থ করবার আশায় এই সমস্ত দুষ্কৃতকারীরা কৃষ্ণবহির্মুখ আচরণ করে এবং স্বাড়ম্বরে মহামায়া দুর্গা বা কালী পূজার উদ্দেশ্যে নানা আয়োজনে উদ্যোগী হয়।

সাধারণত চোর-ডাকাতেরা মহামায়ার ভয়ংকরী রূপ চণ্ডী, কালী ইত্যাদি দেবীর পূজা করত। তারা মদ্যপায়ী, অন্যান্য নেশাদ্রব্যে আগ্রহী এবং মাংসপ্রিয়। বিভিন্ন কামনা-বাসনা দোষে তারা মুক্তিদাতা মুকুন্দপুর শ্রীহরির প্রতি বিমুখ হয়ে দুর্গা, চণ্ডী কিংবা কালীর ভক্ত হয়।

কামৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেঽন্যদেবতাঃ। (গীতা ৭/২০)
যাদের মন জড় কামনা-বাসনার দ্বারা বিকৃত, তারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বাদ দিয়ে নানা দেব-দেবীর শরণাগত হয়। কিন্তু জাগতিক কামনা-বাসনা কৃষ্ণভক্তের কাছে ভক্তিপথের প্রতিবন্ধক।

দেব-দেবীর উপাসকেরা দেব-দেবীদের বিভিন্ন দেবলোকে উন্নীত হয় এবং যারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত তারা কৃষ্ণলোকে উন্নীত হয়। দেবান্ দেবযজো যান্তি মদ্ভক্তো যান্তি মামপি (গীতা ৭/২৩) তাই কালীভক্ত ও কৃষ্ণভক্তের গতি কখনই এক নয়।

বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসনা এবং কৃষ্ণভক্তি কখনই এর পর্যায়ের নয়। কারণ দেবোপাসনা হল জড়জাগতিক বা প্রাকৃত, আর কৃষ্ণভক্তি হল সম্পূর্ণরূপে অপ্রাকৃত, চিন্ময়। দেবীধাম অনিত্য পরিবর্তনশীল। কিন্তু কৃষ্ণধাম নিত্য চিরশাশ্বত।

যাদের বুদ্ধি অল্প তারা দেব-দেবীর আরাধনা করে। তাদের আরাধনা লব্ধ ফলও অস্থায়ী।
অন্তবত্তু ফলং তেষাং তদ্ ভবত্যল্পমেধসাম্ (গীতা ৭/২৩)

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণ পুরুষ। অন্যান্য দেব দেবীরা তাঁর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশকণা, যেমন অন্যান্য সমস্ত জীবই ভগবানের ক্ষুদ্র অংশ। দেব-দেবীদের সমস্ত ক্ষমতা ভগবানের কাছ থেকে পাওয়া। ভগবদ্‌কৃপা বিনা দেব-দেবীদের কোনও ক্ষমতা থাকে না।

প্রজাপতি ব্রহ্মা, মহাদেব শিব, সব সময়েই ভগবানের নাম জপকীর্তন করছেন। শ্রীকৃষ্ণের ভজনা করছেন। দেবর্ষি শ্রীনারদ সর্বদা কৃষ্ণনাম কীর্তন করছেন। দেবী দুর্গা স্বয়ং কৃষ্ণভজনের নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যথায় বদ্ধ জীবের দুর্গতি ঘোচে না। (নারদ পঞ্চরাত্রম্ ৪/৩/২০৫ দ্রঃ)

মায়াবাদীরা জগতে অপপ্রচার করে বেড়াচ্ছে যে, জীবই শিব, কালী ও কৃষ্ণ এক, অর্থাৎ সবই ভগবান। প্রকৃতপক্ষে এই কথাগুলি অপরাধমূলক এবং নাস্তিক ভোগীদেরই কথা।

অনেকে আবার যুক্তি খাড়া করে যে শ্রীকৃষ্ণও কালীরূপে লীলা করেছিলেন। কথাটি ঠিক যে, শ্রীকৃষ্ণও কালীরূপে লীলাবিলাস করেছিল কৃষ্ণবহির্মুখ ব্যক্তিদের বিমোহিত করবার জন্য। শ্রীকৃষ্ণ বিভিন্নরূপ ধারণ করতে পারেন কিন্তু তিনি কালী নন।

শ্রীকৃষ্ণ বিভিন্ন অবতারে মৎস্য, কূর্ম কিংবা শুকর ইত্যাদি রূপ ধারণ করতে পারেন, তাই বলে বিশেষ মৎস্য, কূর্মাদিকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলে মনে করাটা নির্বুদ্ধিতা।

....হরেকৃষ্ণ....
সংযুক্ত ছবি - কল্পিত। শুধু কেবল পোস্ট প্রাসঙ্গিকে ব্যাবহৃত হয়েছে৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন