শ্রীঅদ্বৈত আচার্য (লাউর/পণতীর্থ)




 মাঘী শুক্লা সপ্তমী তথা শ্রীঅদ্বৈত সপ্তমী তিথিতে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ বংশে পিতা শ্রীকুবের পণ্ডিত ও মাতা শ্রীমতী নাভাদেবীকে আশ্রয় করে মহাবিষ্ণুর অবতার শ্রীঅদ্বৈত আচার্য প্রভু শ্রীহট্টের নবগ্রামে আবির্ভূত হন। নবগ্রাম সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর থানায় ভারত সীমান্তবর্তী লাউড় (গড়কাঠি) নাম ধারণ করেছে। লাউরের অন্তর্গত এ নবগ্রামে আনুমানিক ১৪৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবির্ভূত হন।

বঙ্গদেশে শ্রীহট্ট নিকট নবগ্রাম।

‘কুবের পণ্ডিত’ তথা নৃসিংহসন্তান \

কুবের পণ্ডিত ভক্তিপথে মহাধন্য।

কৃষ্ণপাদপদ্ম বিনা না জানয়ে অন্য \

তৈছে তাঁর পত্নী ‘নাভাদেবী’ পতিব্রতা।

জগতের পূজ্যা, যেঁহো অদ্বৈতের মাতা \ (ভক্তিরত্নাকর ৫/২০৪১-৪৩)

শ্রীমতী নাভাদেবীর একবার গঙ্গাøানের বাসনা হয়। তিনি শেষরাতে স্বপ্নে দেখেনÑ তাঁর কোলের শিশুটি চতুর্ভূজ জ্যোতির্ময় সর্বমঙ্গলময় স্বয়ং মহাবিষ্ণু। এরূপ দিব্য দর্শনে শ্রীমতী নাভাদেবী তাঁর স্তবস্তুতি করেন। ঐশ্বর্য ভাবান্বিতা মাতৃদেবীকে তিনি সান্ত্বনা প্রদান করে সমস্ত তীর্থ এনে তাতে তাঁকে স্নান করাবার কথা বলেন। শ্রীমতি নাভাদেবী নিদ্রাভঙ্গে স্বপ্নের বিষয় স্মরণ করে চিন্তামগ্ন হন। তিনি স্বপ্নের বিষয় প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে পুত্রের অনুরোধে তা প্রকাশ করে রোদন করতে থাকেন। আমি ‘পণ’ অর্থাৎ প্রতিজ্ঞা করে বলছি- তোমার ইচ্ছে পূরণের জন্য আমি আজ রাতে সকল তীর্থকে আনয়ন করব, তাতে তুমি স্নান করবে। অদ্বৈত প্রভু রাতেই যোগাবলম্বন পূর্বক তীর্থগণকে আকর্ষণ করলে, সমস্ত তীর্থ শ্রীঅদ্বৈত প্রভুর কাছে উপস্থিত হয়ে তাদের আহ্বানের কারণ জিজ্ঞেস করেন। শ্রীঅদ্বৈত প্রভু বলেন- মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে (মহাবারুণি) তোমরা সকলে এখানে পর্বতোপরি বিহার করবেÑ সকলে আমার কাছে এই ‘পণ’ করো। গঙ্গা-যমুনাদি সকল তীর্থই শ্রীঅদ্বৈতাচার্য প্রভুর আজ্ঞা স্বীকার করে পর্বতে বিহার করতে থাকেন।

শ্রীঅদ্বৈতচন্দ্র প্রভাতকালে জননী নাভাদেবীকে বলেন মা! পর্বতোপরি সমস্ত তীর্থ এসেছে, তুমি সেখানে গিয়ে øান করো। শ্রীমতী নাভাদেবী কৌতূহলবশত পুত্রসহ সেখানে যান। শ্রীঅদ্বৈতচন্দ্র জননী নাভাদেবীর পাশে দাঁড়িয়ে শঙ্খ-ঘণ্টা বাজিয়ে উচ্চৈঃস্বরে হরিধ্বনি করতে থাকেন। হরিধ্বনি করামাত্রই অঝোরে জলের প্রবাহ পতিত হতে থাকে। শ্রীঅদ্বৈতচন্দ্র তখন বলেন, দেখ মা তীর্থের জল পড়ছে। এখানে এখন সকল তীর্থ অবস্থান করছে। ঐ দেখ মা, মেঘের মতো যমুনার জল তোমাকে ভিজিয়ে ফেলেছে, গঙ্গার পুণ্যসলিলবিন্দু তোমাকে সিক্ত করছে। এভাবে অন্যান্য সকল তীর্থের পুণ্য সলিলরাশি পতিত হতে থাকে। অতি আশ্চর্য এ দৃশ্য দর্শন করে এবং পুত্রের বাক্য শ্রবণে শ্রীমতী নাভাদেবীর বিশ্বাস হয় যে, সত্য সত্যই এখানে তীর্থ সকল এসেছেন। তিনি অত্যন্ত ভক্তিভরে তীর্থসমূহকে প্রণাম করে সেই জলে স্নান করলেন। সেই থেকে এ স্থান ‘পণতীর্থ’ নামে খ্যাত হয়। শ্রীঅদ্বৈত প্রভু কর্তৃক স্বীয় জননী নাভাদেবীর অভিলাষ পূর্ণ করার জন্য এবং তীর্থগণের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে (মহাবারুণি) এখানে আবির্ভূত হওয়ার জন্য ‘পণ’ করার কারণেই পণতীর্থের প্রসিদ্ধি। মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে এখানে মেলা বসে। ঐ পুণ্য স্নানের দিনে অদ্যাপিও লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রীর সমাগম হয়।

বর্তমানে সেখানে কোনো প্রাচীন স্মৃতি নেই। যাদুকাটা নদীর পূর্বপাড়ে স্থানীয় ভক্ত দ্বারা নির্মিত শ্রীঅদ্বৈত মন্দির রয়েছে। আর পশ্চিম পাড়ে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইস্কন) কর্তৃক শ্রীশ্রীরাধা মদনগোপালের সুবৃহৎ মন্দির নির্মিত হয়েছে। মন্দিরে শ্রীশ্রীরাধা মদনগোপাল, শ্রীশ্রী জগন্নাথ বলদেব সুভদ্রা ও শ্রীল অদ্বৈত আচার্যের বিগ্রহ স্থাপিত হয়েছে। শ্রীঅদ্বৈত আচার্যের আবির্ভাব তিথিতেও এখানে বিশাল মহোৎসব হয়।

পথনির্দেশ

সুনামগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশাযোগে নদীঘাটে যেতে হবে। সেখান থেকে নৌকায় মনিপুর ঘাট, তারপর অটোরিকশা বা মোটরসাইকেল যোগে পণাতীর্থে আসা যায়। তবে বর্ষাকালে সুনামগঞ্জ থেকে সরাসরি পণাতীর্থ নদীঘাটে আসা যায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন