সন্তানের জন্য দায়িত্ব

 আগেরকার দিনে গৃহস্থদের শিশুর জন্ম, উত্থান উৎসব, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি বহু রকমের বৈদিক মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান ছিল। আজকাল আধুনিক সমাজের মানুষ সেই সমস্ত মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান ভুলে গেছে। গার্হস্থ ধর্ম হচ্ছে সন্তান উৎপাদন করা এবং সন্তান যাতে শ্রীভগবানের পাদপদ্মে উপনীত হতে পারে সেই দায়িত্ব গ্রহণ করা। সেজন্য সমস্ত মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সন্তানের জাগতিক ও পারমার্থিক শিক্ষার ব্যাপারে যত্ন নেওয়া অবশ্য দরকার।




আধুনিক পাশ্চাত্যদেশে গৃহস্থরা সন্তান চায় না। কেননা তাদের মনোভাব হল, সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে পালন পোষণ ইত্যাদি অনেক কষ্টের ব্যাপার। তাই সন্তান না থাকাটা তারা নাকি ভালো মনে করে। তাতে দেখা যায়, সরকার খুব চাপ দিচ্ছে যাতে বেশী সন্তান না জন্মায়। কেননা জনসংখ্যা বৃদ্ধি হলে আর্থিক, সামাজিক নানাবিধ অসুবিধা হবে।

ফিনল্যান্ডের মানুষ কি কম সন্তান কি বেশী সন্তান– কোনও সন্তানই তারা চায় না। ‘পরিবার পরিকল্পনা’ নিয়েই তারা জীবন অতিবাহিত করে। তারা মনে করে সন্তান গ্রহণ করা মানেই যন্ত্রনা আর ঝামেলা। তার চেয়ে যেভাবে আছি সেভাবে থাকি আর ভোগ করে যাই। কোনও ঝামেলার বালাই নেই। তাদের এই মনোভাবের জন্য ফিনল্যান্ডের জনসংখ্যা খুব কমে যাচ্ছে। আগামী ত্রিশ বছরে মধ্যে যদি এভাবে সন্তান না জন্ময়, তা হলে ফিনল্যান্ড ফিনিস্ড্ বা শেষ হয়ে যাবে। তাদের সরকার গৃহস্থদের সন্তান উৎপাদন করতে উৎসাহ দিচ্ছে। যদি তাদের সন্তান হয় তবে দুলক্ষ করে টাকা সরকার থেকে দান করা হবে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, ‘আমাদের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি করার প্রয়োজন।’ তিনি বলেছেন ‘সন্তানের জন্ম বেশী হোক, কিন্তু বাইরের কোনও দেশ থেকে সন্তান নেওয়া হবে না। এখানেই সন্তান উৎপাদন করা হোক।’

শ্রীল প্রভুপাদ বলেছিলেন, সুসন্তান দরকার। পাঁচটি সন্তানের মধ্যে একটি যদি মন্দ হয় তা হলে সারা পরিবার সে নষ্ট করে দেবে। পাঁচজনই যদি সুন্দর গুণশালী হয় তাহলে সেইভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হলে কোনও দোষ নেই।

শাস্ত্রে আছে অষ্টমী, একাদশী, ব্রত উপবাসের দিন গর্ভাধান নিষিদ্ধ। আধুনিক মানুষেরা গর্ভাধান সংস্কার বিষয়ে সচেতন থাকে না। ভাগবতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, অসময়ে কশ্যপ-পত্নী দিতি গর্ভধারণ করেছিলেন। তার ফলে তাদের যে সন্তান জন্ম নিয়েছি তারা ছিল অত্যন্ত ভয়ংকর অসুর। কশ্যপ বলেছিলেন, সন্ধ্যাকালে শিবের অনুচরেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, এই সময়ে গর্ভধারণ করলে সন্তান অসুর হবে। কিন্তু দিতি অধৈর্য হয়েই কশ্যপের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন।

গর্ভাদান সংস্কারের দিন ভোরের মঙ্গল আরতি দর্শণ করে শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের কাছে সৎসন্তান প্রার্থনা করতে হবে। কমপক্ষে পঞ্চাশ মালা হরিনাম জপ করতে হবে। যেখানে কোনও বৈদিক নিয়ম কানুন নেই সেই সমাজে যে সমস্ত সন্তান জন্মগ্রহণ করে তারা প্রায় সকলেই কুলক্ষণযুক্ত সন্তান হয়ে থাকে। তারা তাদের পরিবারে, তাদের সমাজে বিশৃঙ্খলতাই আনবে। বর্তমানে লোকে পরিবার পরিকল্পনা করে থাকে। লোকে সন্তান চায় না, এমন অবস্থায় যদি সন্তান জন্মগ্রহণ করে সেও বর্ণ-সঙ্কর সন্তান। বিশৃঙ্খল।

বালকালে আমার এক বন্ধু ছিল। তার চরিত্র ভাল ছিল না। একদিন সে বলেছিল, ‘আমার বাবা-মা আমাকে বলেছে যে, তারা আমাকে চায়নি। তারা পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু তবুও হঠাৎ যেন আমর জন্ম হয়েছে। …….’ তারপর সে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

আসল কথা হচ্ছে, সন্তান যদি কৃষ্ণভক্ত হয়, তবে জগতের কল্যাণ। কম সন্তান বেশী সন্তান নিয়ে কোনও কথা নয়। ভক্ত হলে জগতের মঙ্গল।

শচীমাতার নয়টি কন্যা সন্তান মারা গেল। তারপর বিশ্বরূপ ও নিমাইয়ের জন্ম হয়। ছোট পুত্রের নামকরণ কালে শ্রী নীলাম্বর চক্রবর্তী শিশুর নাম রাখলেন বিম্বম্ভর । নীলাম্বর চক্রবর্তী ছিলেন মহান জ্যোতিষী। তিনি বুঝেছিলেন, এই সন্তানটি সারা বিশ্বের ভরণ-পোষণ করবে। তাই নাম রাখলেন বিশ্বম্ভর। স্ত্রীলোকেরা পিশাচী-ডাকিনীর মুখে নিম-তিতা সূচক ‘নিমাই’ নাম দিয়েছিলেন। শিশুর কোষ্ঠিবিচার, নামকরণ, রুচি পরীক্ষা বিভিন্ন উৎসব করা হয়। জগন্নাথ মিশ্র একটি বড় থালাতে সোনা, রূপা, কড়ি পয়সা, কলম, ভাগবত গ্রন্থ, ফুল, শস্য ইত্যাদি দ্রব্য রেখে শিশু পুত্র নিমাইয়ের রুচি পরীক্ষা করছিলেন। নিমাই তখন শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থটি আলিঙ্গন করেছিল।

শ্রীল প্রভুপাদের বাবা কলকাতার মাহাত্মাগান্ধী রোডে থাকতেন, রাধাগোবিন্দ পূজা করতেন। তাঁর কাপড়ের দোকান ছিল। সাধুসেবা করতেন। হরিনাম করতেন। প্রায় দিনই সাধুদের নিমন্ত্রন করে ভোজন করাতেন। সাধুদের কাছে তিনি তাঁর পুত্র অভয়ের (প্রভুপাদ) জন্য বলতেন, আপনারা আমার ছেলেকে আশীর্বাদ করুন যাতে ওর প্রতি রাধারাণীর কৃপা হয়। যাতে ওর কৃষ্ণভক্তি হয়।’

বাবা চিন্তা করেছিলেন, আমার ছেলেকে বিদেশে পাঠাব না সাহেব হতে। আমি আমার ছেলেকে সাধন-ভজন শেখাবো।

মা-বাবার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে, যে-সন্তানের জন্ম দেওয়া হল, সেইটাই যেন তার শেষ জন্ম হয়। তাকে যেন আর এই বারংবার জন্মমৃত্যুর দুঃখময় চক্রে না আসতে হয়। পড়াশোনার ব্যাপারে দেখা যায়, আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা প্রভৃতি দেশে লোকেরা ছেলেমেয়েদের মুখস্থ বিদ্যার শেখায় না। তাদের কিছু নীতি এবং তার প্রয়োগ শেখানো হয়। আর, ভারতে অনেক কিছু মুখস্থ করে পড়তে হয়। দিনরাত পড়ার চাপ। শোনা গেল, কিছুদিন আগে, একটি ছেলে পরীক্ষা দিয়েছে। তারপর পাশ করবে কিনা সেই চিন্তায় ভারাক্রান্ত হয়ে আত্মহত্যা করে বসে।

এটা কিরকম শিক্ষা? জীবনের উদ্দেশ্যটি কী? ছেলেরা প্রায়ই এই শিখেছে যে, শিক্ষার উদ্দেশ্য– ভাল পদমর্যাদা, ভাল একটা চাকুরি পাওয়া। কিন্তু আবহমান কাল জন্ম-মৃত্যুর যাতনা থেকে উর্ত্তীণ হওয়ার শিক্ষাটি কে পাচ্ছে? মা-বাবা তাদের সন্তানদের কি শিক্ষা দিচ্ছেন? পড়াশুনা করছি কেন? ভাল চাকরী হবে। ভাল পড়া করতে না পারলে চাকরী পাব না। চাকরী না পেলে আমার জীবন অচল। চাষ করব না, অন্য কিছু করব না। আমি হতাশ গ্রস্ত। এভাবে শিক্ষার কোনও মূল্য নেই।

বাড়িতে নামহট্ট পরিবেশ থাকা দরকার। বাড়িতে কৃষ্ণভক্তি শেখা দরকার। চাকরী-বাকরী যা কর– সবই শেখা দরকার। কিন্তু শেষ জন্ম হওয়ার শিক্ষাটা অবশ্যই দরকার। হরিনাম জপ করা দরকার। ছোটবেলা থেকে হরিভজনের অভ্যাস থাকা দরকার। কাঁচা মাটি যেভাবে গড়াও গড়বে, কিন্তু মাটি পোড়ানো হয়ে গেলে আর তাকে নতুন করে গড়ানো যায় না। তাই ছোটবেলা থেকে সদ্ অভ্যাস করা দরকার।

দক্ষিণ ভারতে আমার এক শিষ্য আছে। সে ভাল টাকা রোজগার করে। সে বিয়ে করল। ভক্ত হল। সে ও তার স্ত্রী দুজনেই তাদের সারাদিন কাজকর্মের পর সন্ধ্যাবেলায় শ্রীশ্রীরাধাগোবিন্দ মন্দিরে সন্ধ্যা আরতিতে যোগ দেয়। একদিন তার বাবা এসে দেখল, ওরা সব কাজ করছে, হরিনাম করছে, মন্দিরে যাচ্ছে এ সব দেখে বাবা বলল, ‘এ কি! তোমরা অল্প বয়সে এসব করছ কেন? তোমরা ভোগ বিলাস কর। আনন্দ স্ফূর্তি কর। এখন ওসব করার দরকার কি?’

বাবার বয়স পঁয়ষট্টি বছর। তার ছোট ভাই একদিন বলছে, ‘তুমি তো বুড়ো হলে, আর ঘরের চিন্তা করো কেন, যাও তীর্থ ভ্রমণ কর। বৃন্দাবনে যাও। তা হলে শেষ জীবনটাও সার্থক হবে।’ কিন্তু পঁয়ষট্টি বছরের বয়স্ক লোকটি বলছে, ‘বৃন্দাবনে যাব? ও আমার অভ্যাস নেই। আমার টাকাগুলো ইউনিয়ন ট্রাস্টে রাখব, চিট ফান্ডে রাখব, পিয়ারলেসে রাখব। ছেলের বিয়ে হল। নাতনী আছে। তাদের কথা তো চিন্তা করতে হবে।’ কয়েক দিন পরেই হঠাৎ হার্ট এ্যাটাকে লোকটি মারা গেল। এই হল অবস্থা।

বুদ্ধিমান মানুষেরা বরাবরই পারমার্থিক কল্যাণের জন্য হরিভজনের অভ্যাস করে চলেন। কৌমারং আচরেৎ প্রাজ্ঞো। প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি শৈশব অবস্থা থেকে সাধনভজন অনুশীলন করবেন।

আমার মা একদিন আমাকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কেন অল্প বয়সে ব্রহ্মচারী হরে? আমি বললাম, মা আমি আর কতদিন বাঁচব তুমি জানো? মা বললেন ‘তা আমি বলতে পারব না।’ ‘আমি আর কতদিন বাঁচব তুমি বলতে পারছ না? তা হলে আমি এখন থেকেই ধর্ম করতে থাকি।’

কে কতদিন বাঁচে? তাই প্রথম থেকে অভ্যাস করা উচিত। গৃহস্থরা সাধন-ভজনে মতি রাখবে। তারা আত্মীয় বন্ধু বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী অন্যান্যদেরও প্রেরণা দিয়ে ভক্তিপথে আনবে। তারা যা শিখবে পরবর্তীতে তাদের সন্তান সন্ততিরা সেই শিক্ষার সুযোগ পাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন