গুরুদেবের কর্মযজ্ঞে সহায়তাই গুরুভক্তি

 


শ্রীমদ্ভাগবতের তৃতীয় স্কন্ধে ৩১ অধ্যায়ের ১৬ শ্লোকে বলা হয়েছে, পরমেশ্বর ভগবান অন্তর্যামী পরমাত্মারূপে সকলের হৃদয়ে বিরাজ করছেন, তিনি ছাড়া আর কে স্থাবর এবং জঙ্গম বস্তুদের পরিচালনা করতে পারেন? তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ– কালের এই তিনটি অবস্থায় বিরাজ করেন। তাঁরই নির্দেশনায় বদ্ধ জীব বিভিন্ন কার্যকলাপে যুক্ত হয়, এবং বদ্ধ জীবনের ত্রিতাপ দুঃখ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য, আমাদের কেবল তাঁরই শরণাগত হতে হবে।

অনবদ্যভাবে ভাগবত-ভাষ্যপ্রদানকারী কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ এই উপদেশের তাৎপর্য বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে লিখেছেন, বদ্ধ জীবন যখন ঐকান্তিকভাবে মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত হতে উৎসুক হয়, তখন তাঁর হৃদয়ে পরমাত্মারূপে বিরাজমান পরমেশ্বর ভগবান তাকে এই জ্ঞান প্রদান করেন– “আমার শরণাগত হও।” ভগবদ্গীতায় ভগবান বলেছেন, “সমস্ত ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও।” আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, সমস্ত জ্ঞানের উৎস হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান। তা ভগবদ্গীতাতেও প্রতিপন্ন হয়েছে। মত্তঃ স্মৃতির্জ্ঞানমপোহনং চ। ভগবান বলেছেন, “আমার মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞান ও স্মৃতি লাভ হয়, এবং বিস্মৃতিও আমার থেকেই আসে।” যিনি জড়জাগতিক বিচারে তৃপ্ত হতে চান অথবা যিনি জড়া প্রকৃতির উপর আধিপত্য করতে চান, ভগবান তাঁকে তাঁর সেবার কথা ভুলে যাওয়ার সুযোগ দেন এবং জড়জাগতিক কার্যকলাপের তথাকথিত সুখে নিমগ্ন করেন।

তেমনই কেউ যখন জড়া প্রকৃতির ওপর আধিপত্য করতে গিয়ে নিরাশ হয়ে, ভববন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ঐকান্তিকভাবে আগ্রহী হন, তখন ভগবান অন্তর থেকে তাঁকে শরণাগত হওয়ার জ্ঞান প্রদান করেন, এবং তারই ফলে তিনি মুক্ত হন।

পরমেশ্বর ভগবান অথবা তাঁর প্রতিনিধি ব্যতীত কেউই এই জ্ঞান প্রদান করতে পারে না। শ্রী চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে শ্রীল রূপ গোস্বামীকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু উপদেশ দিয়েছেন যে, জড় জগতে নানা প্রকার দুঃখ-দুর্দশা ভোগ করতে করতে, জীব জন্ম-জন্মান্তর ধরে ভ্রমণ করছে। কিন্তু সে যখন জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ঐকান্তিভাবে আগ্রহী হয়, তখন শ্রীগুরুদেব ও শ্রীকৃষ্ণের মাধ্যমে সে দিব্যজ্ঞান লাভ করে। অর্থাৎ পরমাত্মারূপে শ্রীকৃষ্ণ জীবের হৃদয়ে বিরাজ করছেন, এবং জীব যখন  ঐকান্তিকভাবে আগ্রহী হয়, তখন ভগবান তাকে তাঁর প্রতিনিধি বা সদ্গুরুর শরণাগত হওয়ার নির্দেশ দেন। অন্তর থেকে এইভাবে পরিচালিত হয়ে এবং বাইরে গুরুদেবের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে, জীব কৃষ্ণভক্তির পন্থা প্রাপ্ত হয়, যা হচ্ছে সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার উপায়।

তাই পরমেশ্বর ভগবানের আশীর্বাদ ব্যতীত স্বরূপে অধিষ্ঠিত হওয়ার কোন সম্ভবনা নেই। পরম জ্ঞানে আলোকপ্রাপ্ত না হলে, জড়া প্রকৃতিতে কঠোর জীবন সংগ্রামে জীবকে তীব্র যাতনা ভোগ করতে হয়। তাই গুরুদেব হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবানের কৃপার মূর্ত বিগ্রহ। বদ্ধ জীবকে প্রত্যক্ষভাবে গুরুদেবের আদেশ প্রাপ্ত হতে হয়, এবং তার ফলে সে ধীরে ধীরে কৃষ্ণভক্তির পথে অগ্রসর হয়। গুরুদেব বদ্ধ জীবের হৃদয়ে কৃষ্ণভক্তির বীজ বপন করেন, এবং গুরুদেবের উপদেশ শ্রবণ করার ফলে, সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়, এবং তখন তার জীবন ধন্য হয়।

শ্রীমদ্ভাগবতের ৩/২৯/৮ শ্লোকের তাৎপর্যে শ্রীল প্রভুপাদ লিখেছেন, বদ্ধ অবস্থায় কেউ যখন ভক্তিতে প্রবৃত্ত হয়, তখন তাকে সম্পূর্ণরূপে শরণাগত হয়ে, সদগুরুর নির্দেশ পালন করতে হয়। গুরুদেব হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবানের প্রকটি প্রতিনিধি, কারণ তিনি গুরু-পরম্পরার মাধ্যমে পরমেশ্বর ভগবানের আদেশ যথাযথভাবে প্রাপ্ত হন এবং তা প্রদান করেন।

ভগবদ্গীতায় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, গীতার জ্ঞান পরম্পরা ধারায় প্রাপ্ত হওয়া উচিত, তা না হলে তাতে ভেজাল থাকবে। পরমেশ্বর ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে, সদ্গুরুর নির্দেশ অনুসারে আচরণ করাই হচ্ছে শুদ্ধ ভক্তি।

শ্রীমদ্ভাগবতের (৫/৫/২) শ্লোকে বলা হয়েছে, মায়ার জড়জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্ত হতে হলে পরম নিরপেক্ষ মহৎ- এর সেবা করতে হয়। ভগবানের সান্নিধ্য লাভের অভিলাষ না থাকলেও মহৎ সঙ্গ একান্ত প্রয়োজন। মহৎ সেবা না করলে অসৎ সঙ্গের প্রবৃত্তি জাগে। মহৎ জন আমাদের শিক্ষা দেন কিভাবে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভালবাসতে হয়। মহৎ সেবা সেই শিক্ষার সুযোগ এনে দেয়।

শ্রীকৃষ্ণকে ভালবাসার শিক্ষা গ্রহণ করলে পাপকর্ম থেকে মুক্তিলাভ হয়, পাপের কর্মফল দূর হয়, সুপ্ত কৃষ্ণপ্রেম জাগে। ভাগবতে বিভিন্ন স্থানে সর্বত্র বলা হয়েছে, এই জড় জগৎ দুঃখ দুর্দশায় পরিপূর্ণ, তাই গুরুর নির্দেশে কৃষ্ণভাবনার পথ অনুসরণ করে সেই দুর্দশার পথ ছাড়া যায়। সমগ্র ভাগবতে সেই ভগবদ্ভক্তির রসামৃত পরিবেশন করা হয়েছে।

ভগবদ্ভক্তগণ গুরুদেবের ভগবৎ-সেবার ব্রতসাধনে আত্মনিয়োগ করে, তাঁকে সন্তুষ্ট করে কৃষ্ণভাবনামৃত আস্বাদনের সুযোগ লাভ করেন। শ্রীল প্রভুপাদের আবির্ভাব শতবার্ষিকীর প্রাক্কালে আমরা সেই বাণী স্মরণ রেখে গুরুদেবের অভিলাষ পূরণার্থে আত্মনিয়োগ করে থাকব। সেই লক্ষ্য পূরণে আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা থাকবে অব্যাহত।

সাফল্যের রহস্য হল গুরুদেবের ভগবৎ সেবন ব্রতের অভিলাষ সর্বপ্রকার গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা। সেটাকে নিজের ব্রত অভিলাষ রূপে স্বীকার করে নেওয়া উচিত। শ্রীল প্রভুপাদের বাণী থেকে কিছুমাত্র বিচ্যুতি বা দ্বন্দ্বের অবকাশ রাখা অনুচিত। এই যে ব্যাসপূজা উৎসব, এর তাৎপর্যই হল– এই শুভ উপলক্ষ্যে গুরুদেবের কাছে তাঁর অভিলাষ পূরনের সেবা অঙ্গীকারের একটি আনুষ্ঠানিক সুযোগ।

গীতায় (২/৪) বলা হয়েছে, গুরুদেবের চরণকমলে সেবা নিয়োজিত থাকলে, তাঁর আনুকূল্যে পরমেশ্বর ভগবানের সান্নিধ্য লাভের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়। ভগবানের দর্শন যারা পেতে চায়, তাদের উচিত দীক্ষাগুরুর সেবায় মনপ্রাণ অর্পণ করা।

শ্রীমদ্ভাগবতের চতুর্থ স্কন্ধের বিংশতি অধ্যায়ের বিভিন্ন শ্লোকের বর্ণনা প্রসঙ্গে শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, সদগুরুর কাছ থেকে প্রাপ্ত ভগবানের আদেশ পালন করাই মানুষের কর্তব্য। ‘ব্যবসায়ত্মিকাবুদ্ধিঃ– বলতে সেই কথাই বোঝায়– প্রতিটি মানুষেরই কর্তব্য ভগবানের আদর্শ প্রতিনিধি গুরুদেবের নির্দেশ প্রাণাপেক্ষা প্রিয় বলে পালন করা।

শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর উল্লেখ করেছেন, মুক্তিলাভ হবে কিনা সেই সম্বন্ধে কোন রকম চিন্তা না করে, শ্রীগুরুদেবের সাক্ষাৎ আদেশ পালন করে যাওয়া উচিত। তা করলে সর্বদাই মুক্ত থাকা যায়।

শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের অভিলাষ মতো গৌড়ীয় মঠ চলেনি বলেই তা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে। গুরুদেবের উপদেশ স্মরণ করে জীবনপথে যে কাজেই অগ্রসর হওয়া যায়, তা সর্বশুভ হয়। তা না করে ওরা জিজ্ঞাসা করে, ইসকনের গুরুভক্তি ব্যাপারটা কি ধরনের।

সকলেরই জানা দরকার, ইসকনে গুরুসেবার মান অনেক উচ্চে। ভক্তের মধ্যে এখানে সেবার অভিলাষ সর্বদা জাগিয়ে তোলা হচ্ছে নানা উৎসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। ইসকনের ভক্তদের গুরুনিষ্ঠা সম্পর্কে জনসমাজে উচ্চ ধারনা আছে।

সেই নিষ্ঠা থেকে বিচ্যুত হয়ে ভক্তিমার্গ থেকে বিপথগামী হওয়ার যথেষ্ঠ সম্ভাবনা। শ্রীল প্রভুপাদ এই কারণেই একটি নীতি দৃঢ়ভাবে মেনে চলতে বলতেন–তা হল গুরুদেবের ভগবৎ-সেবন ব্রত সাধন।

গুরুদেবের ভগবৎ-ব্রত সাধনের মাধ্যমে তাঁকে সন্তুষ্ট করলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সন্তুষ্ট হন এবং শ্রীকৃষ্ণ সন্তুষ্ট হলে তিনি ভক্তকে দিব্য জ্ঞানের আলোক প্রদান করেন। সেই জ্ঞান শুদ্ধ ভক্ত সঙ্গের মাধ্যমে শিষ্যের কাছে নেমে আসে।

এমন কি শুদ্রেরাও ভগবদ্ভক্তির মাধ্যমে গুরুকৃপায় কৃষ্ণভাবনামৃত আস্বাদন করতে পারে। কলিযুগে শুদ্রেরাও এই পন্থায় কৃষ্ণভক্তি অর্জন করতে সক্ষম।

গুরুদেবের বাণী শ্রবণ করতে করতে তার অর্থ উপলব্ধি হলেই শিষ্যের অগ্রগতি শুরু হয়ে যায়। গুরুর ভক্তিলতায় জল সিঞ্চন করলে তা ক্রমেই গোলোকধাম অবধি বৃদ্ধি পায়।

গুরুভক্তির ধারা পরম্পরাক্রমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণে পৌঁছায়। গুরুদেবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত ভক্তি শ্রদ্ধার্ঘ সবই তিনি গুরু-পরম্পরাক্রমে পূর্বতন গুরুর কাছে নিবেদন করেন। সেইভাবেই পরম্পরাক্রমে তা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিবেদিত হয়।

লোকে ভাবে, কৃষ্ণভক্তির ফলে শ্রীকৃষ্ণ আমাকে কি দেবেন? কিন্তু শুদ্ধ ভক্ত ভাবেন, পরমেশ্বর ভগবান যিনি আমাকে না চাইতেই এত কিছু দিয়েছেন, তাঁর সন্তুষ্টির জন্য আমি কি সেবা করতে পারি?

যথার্থ ভগবদ্ভক্ত সর্বদা ভাবেন, কেমন করে আরও শুদ্ধভাবে ভক্তিমার্গে এগিয়ে চলা যায়, কিভাবে আরও সুশৃঙ্খলভাবে পারমার্থিক জীবন যাপন করা যায়, কিভাবে ভগবানের দিব্য-প্রতিনিধি শ্রী-গুরুদেবকে সন্তুষ্ট রাখা যায়, কিভাবে মন্দির গড়ে তোলা যায়। পূজারী ভক্ত চিন্তা করবেন, কেমন করে ভগবানের উপাসনা আরও সুন্দর, আরও সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করা যেতে পারে। ভগবানের নামের প্রচারক চিন্তা করবেন, কিভাবে ঘরে ঘরে নামের মহিমা আরও ব্যাপকভাবে পৌঁছে দেওয়া চলে।

এইভাবেই প্রত্যেকে গুরু-পরম্পরা ধারায় তার গুরুদেবের কাজে সহায়তা করতে পারে। প্রত্যেকেরই মনোভাব হওয়া উচিত গুরুর বিপুল কর্মযজ্ঞে যে যেভাবে সহায়তা করতে হবে, গুরুকে সেবা করতে হবে এইভাবে ভৃত্যের মতো।

এইভাবে গুরুদেবের সহায়তা করা হলে তিনি সেই সেবা-সহায়তা শ্রীকৃষ্ণের কাছে অর্পণ করেন। তাই তার ফললাভ হয় ভক্তেরই। তাই গুরু-বৈষ্ণবগণের সেবা থেকে নিবৃত্ত হওয়া অনুচিত। গুরু-বৈষ্ণবের সেবার মাধ্যমেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সন্তুষ্ট হন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সাক্ষাৎভাবে সন্তুষ্ট করার মূল নীতি হল গুরুভক্তি এবং শুদ্ধ বৈষ্ণব সেবা।

মীরাবাঈ ছিলেন এক মহান ভক্ত রমণী। কিন্তু তিনি গুরুদেবের সেবার মাধ্যম স্বীকার না করে সরাসরি শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের ভজনা করতেন বলে বিপুলভাবে বৈষ্ণবসমাজে সমালোচনার সম্মুখীণ হয়েছিলেন। কারণ শ্রীল জীব গোস্বামীর নির্দেশ তিনি উপলব্ধি করেননি, ফলে দাসানুদাসের মতো বিনয়নম্রভাবে গোপীপদরেনুর অভিলাষ না করেই শ্রীকৃষ্ণের চরণাশ্রয় করেছিলেন।

জগদ্গুরু শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের শ্রীচরণে তাই আমি প্রার্থনা জানাই যেন আমরা গুরুভক্তির নিষ্ঠা থেকে বিচ্যুত না হই। শুদ্ধ বৈষ্ণবের রীতি এবং জীবন দর্শন অক্ষুন্ন রেখে আমরা যেন পরমারাধ্য গুরুদেবের বাণী অনুসরণের মাধ্যমে তাঁকে সন্তুষ্ট করে, তাঁর সেবাকার্যে সহায়তার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের করুনা লাভের পথে অবিচল থাকতে পারি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন