শ্রীমদ্ভাগবত কেন পড়বেন

 শ্রীল ব্যাসদেব যে শ্রীমদভাগবত রচনা করেছিলেন, সেটি কোন সাধারণ গ্রন্থ নয়। পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং গ্রন্থাবতার রূপে শ্রীমদ্ভাগবতের মাধ্যমে মানুষের শিক্ষিত সমাজে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলেই আমরা সকলে বিশ্বাস করে থাকি। শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম স্কন্ধের তৃতীয় অধ্যায়ে ৪০ সংখ্যক শ্লোকটি পাঠ এবং মর্ম-উপলব্ধি করলে সেই সত্য হৃদয়ঙ্গম হতে পারে। এমনই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসম্ভারের আলোচনা-পর্যালোচনার উৎসাহ আজ মানব সমাজে পুনরুজ্জীবিত না করতে পারলে, ব্যাপকভাবে ভগবৎ-উপলব্ধি বাস্তবিকই দুঃসাধ্য।


Installs Bhagavad Gita Asitis App : 


ভগবৎ-অবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই গ্রন্থটিকে সকল বৈদিক শাস্ত্রসম্ভার এবং বৈদিক সমাজ ব্যবস্থার অভ্রান্ত সারাৎসার বলেই আমাদের সমানে তুলে ধরেছিলেন। কারণ এই শ্রীমদ্ভাগবতের মধ্যেই পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ সান্নিধ্য লাভে ধন্যাতিধন্য বহু ভগবতশ্রেষ্ঠ পুরুষের বহু নির্বাচিত কথা ও কাহিনী মনোরম আঙ্গিকে পরিবেশিত হয়েছে।

সেই অনবদ্য কাহিনী সঞ্চালনের মধ্যে যেমন মনোহারী গল্পকথার মাধুর্য মনোহরণ করে, তেমনই মর্মে মর্মে অনুভব করা যায় যে, দিব্য গ্রন্থখানির প্রতিটি ছত্রে ভগবত্তার স্বরূপ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে এবং সেই কারণে শ্রীমদ্ভাগবতের পাঠক মাত্রেই পরম শ্রদ্ধা সহকারে শ্রীভগবানের উদ্দেশ্যে স্বভাবতই ভক্তি প্রণতভাবে আপ্লুত হয়ে ওঠেন।

এটাই শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ তথা অনুশীলনের পরম সুফল। সুতরাং আমরা এই গ্রন্থখানি পাঠ করলে শ্রীভগবানের সাক্ষাৎ আশীর্বাদ আমাদের জীবনে সহজলভ্য হয়ে ওঠে, উপরন্তু ভাগবত পাঠকমাত্রেই দিব্যজ্ঞান লাভের আলোকে অন্তরে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন।

যেহেতু শ্রীভগবানই সকল জ্ঞানালোকের উৎস, সকল আশীর্বাদ এবং সকল পরিপূর্ণতার পরম প্রদাতা, তাই শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থখানিও তেমনই চিন্ময় গুণান্বিত গ্রন্থসম্ভার, তাতে কোনই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ থাকা অনুচিত।

যে-গুরুদেব এবং যে ভক্তের হৃদয়ে এমনভাবেই শ্রীমদ্ভাগবতের দিব্যরসের অনুভূতি সঞ্চারিত হতে পেরেছে, তেমন ভাগবত-পুরুষেরই মুখনিঃসৃত ভাগবত-কথা পরম ব্রহ্মজ্যোতির দিব্য আলোক স্বরূপ আমাদেরও জীবন আলোকময় করে তোলে।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর একান্ত পার্ষদ স্বরূপ দামোদর গোস্বামী প্রভু পুরী-ধামে সকল সময়ে শ্রীমন্মহাপ্রভুর দর্শন-অভিলাষী সমস্ত মানুষকেই তাই কোন যোগ্য ভাগবত-পুরুষের কাছে বসে ভাগবত গ্রন্থের পাঠ এবং তাৎপর্য অনুশীলন করতে পরামর্শ দিতেন। সুযোগ্য ভাগবত-পুরুষ বলতে আত্মজ্ঞান সম্পন্ন শ্রীগুরুদেবের কথাই সর্বপ্রথমে আমাদের স্মরণে আসা স্বাভাবিক। তেমন শুদ্ধ পুরুষের কাছ থেকে ভাগবতের তাৎপর্য অনুশীলনের সুযোগ লাভ করতে পারলেই পরম সৌভাগ্য। তখন যেন উপলব্ধি হতে থাকে স্বয়ং শ্রীভগবানই বুঝি কত ভালবেসে আমাদের আগ্রহ আকুলতা চরিতার্থ করবার উদ্দেশ্যে সামান্য ভূমিকা গ্রহণ করেও আমাদের কাছে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন। অবশ্যই পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আশীর্বাদধন্য হতে পারলে, তবেই এমন সার্থকতা আসে জীবনে।

শ্রীমদ্ভাগবতকে গ্রন্থাবতার বলে সম্মানিত করা হয়েছে। এই গ্রন্থসম্ভার যদি আপনার ঘরে থাকে, তা হলে প্রতিদিন দেবতারা সেখানে দিব্যরূপে এসে প্রণতি জানিয়ে যান। একদা শ্রীঅদ্বেত আচার্য প্রভুর একান্ত শিষ্য শ্রীশঙ্করদেব আসাম প্রদেশে শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থবিগ্রহ স্থাপনা করে মন্দির গড়েছিলেন, যেখানে ভাগবতের শ্লোকগীতি উচ্চারণের মাধ্যমে গ্রন্থাবতাররূপে শ্রীভগবানের আরাধনা করা হতো। সেই অঞ্চলটিকে সকলেই বৈষ্ণবভাবাপন্ন শুদ্ধ সাত্ত্বিক নাগরিক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

ভাদ্রপূর্ণিমার পুণ্যদিবসে সকল মন্দিরের বেদীমূলে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রদ্ধাভরে স্থাপনা এবং আরাধনার রীতি ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃতির একটি অঙ্গ। গ্রন্থবিতরণ যজ্ঞ উদ্যাপনের আগেও এইভাবে ভাগবত পূজা করা উচিত।

কলিযুগে মানুষের মনে জ্ঞান এবং বৈরাগ্য সহজে স্ফুরিত হতে পারে না। জড়জাগতিক বহু আকর্ষণ-বিকর্ষণের ফলেই মানুষ এমন দুর্ভাগা হয়ে পড়েছে। নানাপ্রকার টানাপোড়েন থেকে মুক্তি লাভের সব রকম চেষ্টাও মানুষের জীবনে আজ সবই বিফল হচ্ছে।

তাই জ্ঞান বৈরাগ্যমুক্তি– এই সব কিছুর অভাবে মানুষ বিভ্রান্তি বোধ করছে। এমনই অসহায় পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায়– ভক্তি অনুশীলন, যা অতি সহজেই মানুষের মনে জাগিয়ে তোলা সম্ভব। আর সেই অমূল্য ভগবদ্ভক্তি অর্জনের পথে শ্রীমদ্ভাগবতের মনোজ্ঞ কথা ও কাহিনী বিশেষভাবে কার্যকরী হয়, তা আমরা বাস্তব জীবনে লক্ষ্য করেছি।

মুশকিল এই যে, কলিযুগে অনেক ভাগবত-পাঠকই নাম-যশ-অর্থ প্রতিপত্তি অর্জনের লোভে মানুষকে শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম থেকে সারমর্ম না শুনিয়ে, একেবারে দশম স্কন্ধ থেকে শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের রাসলীলার গূঢ় তত্ত্ব বোঝাতে চেষ্টা করে থাকেন। তাতে যথার্থ ভগবদ্ভক্তি জাগে না এবং কাহিনীর যথার্থ পারমার্থিক তাৎপর্যও বোঝা যায় না।

যথার্থ ভগবদ্ভক্ত ভাগবত-পাঠক একেবারে প্রথম স্কন্ধ থেকেই ভাগবতের অমৃতরস ক্রমান্বয়ে শ্রোতাদের কর্ণগোচর করতে থাকেন। তার ফলে ক্রমান্বয়ে জ্ঞান, বৈরাগ্য এবং ভক্তিভাব জাগতে থাকে।

আপনারা যদি তেমন অভিজ্ঞ সুযোগ্য ভাগবত-পাঠক ভক্তের সন্ধান না পেয়ে থাকেন, তা হলে শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের অপূর্ব তাৎপর্যমন্ডিত শ্রীমদ্ভাগবতের খন্ডগুলি নিজেরাই অধ্যয়নের সুযোগ করে নিতে পারেন। শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের অনবদ্য ভাগবত-তাৎপর্য পাঠ করতে থাকলে আপনাদের হৃদয়ে যথার্থ পারমার্থিক জ্ঞানে আলোকদীপ জ্বলে উঠবে এবং সেই আলোকে জাগবে জড়জাগতিক ভোগ-তৃষ্ণার প্রতি আবশ্যকীয় বৈরাগ্যবোধ।

এইজন্য শাস্ত্রে উপদেশ দেওয়া হয়েছে–‘ভাগবত নিত্যসেবয়া’। প্রতিদিন সকালে শ্রীমদ্ভাবগতের একটি করে শ্লোকের তাৎপর্য পড়–ন এবং সকলকে ডেকে শোনাতে থাকুন। ঐভাবে সারাদিনের সকল কর্তব্যকর্মের শেষে, সকলে মিলে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার একটি করে শ্লোক তাৎপর্যসহ অধ্যয়নের অভ্যাস করতে থাকুন।

শ্রীমদ্ভাগবতে রয়েছে পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধীয় কথা আর শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় আছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত পরম তত্ত্বকথা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বহু মানুষ এই অমূল্য গ্রন্থরত্নগুলির যথার্থ তাৎপর্য আজ ভুলেই গেছে। কিন্তু এইগুলিই ছিল ভারতবর্ষের শুদ্ধ সাত্ত্বিক শান্তিপূর্ণ সভ্যতার মূল উপাদান।

বিশেষ করে এখন এই কলিযুগে নানা ধরনের অভূতপূর্ব অচিন্ত্যনীয় দুর্ঘটনা-দুর্বিপাকের দিনে আমাদের সকলেরই উচিত-প্রতিদিন সকাল-সন্ধা শ্রীমদ্ভাগবত এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা চর্চার অভ্যাস আবার ঘরে ফিরিয়ে আনা।

গ্রন্থরাজ শ্রীমদ্ভাগবতের জয় হোক!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন