ভক্তিরত্নকে রক্ষা করুন

 

আমরা যখন মায়ার কবলে পড়ি, যখন আমাদের মাথা নিচু করে চলতে হয়, যখন আমরা নিদ্রাগ্রস্ত হয়ে থাকি, অবসন্ন হই, বহু উদ্বেগ উৎকন্ঠায় মন ভরে থাকে, তখন যদি আমরা যাচাই করে দেখি, তা হলে দেখতে পাব এর মূল কারণটা কি– কারনটা হল আমাদের জীবনে ভবিষ্যতের আশা হারিয়ে ফেলেছি। আমরা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সম্পর্কে আমাদের স্বচ্ছদৃষ্টি হারিয়ে ফেলেছি।

এছাড়া আর কোনই কারন নেই। কৃষ্ণভাবনার মধ্যে কোনও কিছুরই অভাব নেই। কোনও ঘাটতি নেই। যদি কোন কিছুর অভাব থাকে তো সেটা হল কৃষ্ণভাবনার পথ অনুসরণ করে চলায় আমাদের সামর্থ্যরে অভাব। আর সেই অভাবটাও ঘটে আমাদের মনকে বিভ্রান্ত হতে সুযোগ দিই বলে– শ্রীবাস আচার্য ঠিক তাই বলেছেন।

যখন আমরা একটা রত্ন লাভ করি, শুদ্ধ ভক্তির রত্নটিকে যখন অর্জন করি, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপারত্নটি পাই, তখন তাকে সযত্নে রক্ষা করা চাই আমাদের।

আমি যখন বিশ্বপরিক্রমায় যাই, আমি দেখেছি, অনেক জায়গায়, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আয়োজন করা হয়ে থাকে। একটা জনসমাবেশে তো আমাদের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছিল। অনেকেই জানে না, কিছু লোকের হাতে অস্ত্রশস্ত্র থাকেই, কারণ অসুর সম্প্রদায়ের লোকেরা এখন খুব জাহির করে বেড়ায়। তাই তারাই বেশি করে নিজের প্রতিরক্ষার কথা ভাবে।

তবে সেটা তো এক ধরনের আত্মরক্ষার ব্যাপার। কিন্তু আমদের চিন্তা করা উচিত ভগবদ্ভক্তির রত্নটিকে রক্ষা করতে পারি কিভাবে। বৈষ্ণব অপরাধ থেকে, জড়-জাগতিক বাসনা থেকে কিভাবে সেই রত্নটিকে বাঁচাতে পারি।

শ্রীবাস আচার্য প্রভুর জল্পনা-কল্পনাকারীদের সঙ্গে বারবনিতাদের তুলনা করেছেন। তারা এসে আমাদের দু’কান ভরিয়ে তোলে অনেক মিষ্টি কথায়, তাদের প্রজল্প দিয়ে আমাদের মোহিত করে যেন ডাক দেয়, ‘এস আমাদের সাথে’। আর আমরা ঐ সব প্রজল্পকারীদের কথায় কান দিলেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকব এবং তৎক্ষণাৎ অমৃতের আস্বাদন ভুলে যাব। বৃথা মানমর্যাদার মধ্যে তখন আমরা মগ্ন হতে চাইব। নাম-যশ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, প্রশংসাবাদ– এই সমস্ত জড়জাগতিক পর্যায়ের প্রলোভনে আমরা তখন বড় বেশি আকাক্সক্ষা বোধ করব।

তখন যেন ঠিক ডাকাত-পড়ার অবস্থা হয়। বাড়িতে যেন ডাকাত পড়েছে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আর আমাদের ভক্তিরত্ন লুটেপুটে নিয়ে ভাগছে। তাই, এমনি অবস্থায় আমাদের আত্মরক্ষা তথা প্রতিরক্ষার ব্যাপারে খুব অভিজ্ঞ হতেই হবে। প্রতিরক্ষার সব চেয়ে ভাল ব্যবস্থাটা কি হতে পারে?

আক্রমণ করাই হল প্রতিরক্ষার সব চেয়ে ভাল পন্থা। দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলতে হবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী প্রচারকার্যে। সংকীর্তণ প্রচার করতে হবে। যতক্ষণ আপনারা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপা বিতরণ করতে থাকবেন এবং সেই সাথে কৃষ্ণনাম প্রচার করতে থাকবেন, আপনাদের গুরুবাক্য অনুসরণের পথে অবিচল থাকবেন, ততক্ষণ ঐসব অশুভ প্রভাবে চঞ্চল হবার কোন অবকাশই পাবেন না– ঐ ভক্তিরত্ন চুরি হয়ে যাবার কোন ভয়ই আর থাকবে না। তা না হলে, কেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতেই থাকবেন, চোখের সামনে রত্ন চুরি হয়ে যাবে।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এসেছিলেন, তিনি আমাদের কৃপা করেছিলেন এই পবিত্র ধামে এবং আমাদের পথপ্রদর্শক কোন সূত্রই ছিল না। আমরা শুনেছি শ্রীল সৎস্বরূপ গোস্বামীর কাছ থেকে, সেই কথা প্রচারের উদ্দেশ্যে শ্রীল প্রভুপাদ কি কষ্টটাই না করেছিলেন, আমেরিকায় যাওয়ার জন্য, সেখানে যাওয়ার অনুমতি সংগ্রহের জন্য, তাকে ‘স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াতে যেতে হয়েছিল, সেখানে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে, বারে বারে ফিরে আসতে হয়েছে আর কর্মচারী-কেরাণিরা তাঁকে কত হেনস্তা করেছিল, তাঁকে প্রতীক্ষা করে থাকতে হত, এই ফর্ম সেই ফর্মের জন্য তাঁকে হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়েছিল, জাহাজ কোম্পানির কাছে ভিক্ষা প্রার্থনা করতে হয়েছিল তাঁকে, তাঁরা বলতেন, “যাবেন না, পশ্চিমীদেশে যাবেন না, খুব কঠিন জায়গা, আপনার এখন বেশ বয়স হয়ে গিয়েছে, ওখানে গিয়ে মারা পড়বেন। ওখানকার লোকজন সুবিধের নয়, ওদের খুব একটা দয়ামায়া নেই। ভারতবর্ষে সাদাসিধে একটা সাধু হয়ে থাকাটা এক ধরনের ব্যাপার, কিন্তু যদি আপনি পশ্চিমীদেশে যান তো ওরা আপনার সঙ্গে এমন বিশ্রী আচরণ করবে– বিশেষ করে যদি আপনার টাকা-পয়সা আর বন্ধুবান্ধব না থাকে তো কথাই নেই। ওসব মতলব ছেড়ে দিন।”

প্রত্যেকে এমনিভাবে হতাশ করে দিয়েছিল। তিনি রাষ্ট্রদূতের কাছে ছুটতেন, চারিদিকে হন্যে হয়ে ঘুরতেন, কত ঝঞ্ঝাট পোয়াতেন- ধারনা করা একেবারেই অসম্ভব যে, অতখানি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা কেমন করে একটা মানুষের মনের মধ্যে থাকতে পারে– শুধু মাত্র সেই একটি বাণী বহন করার উদ্দেশ্যে এবং কেবল একটি চিন্তা মনের মধ্যে ধারণ করে যে, “আমার গুরুদেবের জন্য এটুকু আমাকে করতেই হবে।”

প্রত্যেকেই তাঁকে বলেছিল, “ যাবেন না। আপনার সিদ্ধান্তটা মোটেই পাকাপোক্ত নয়।” তিনি কে কি বলছে, কারও কথা শোনেননি। শুধুই ছিল তাঁর এক চিন্তা– “আমার গুরুদেব চেয়েছেন, আমাকে যেতেই হবে।”

যদি শ্রীল প্রভুপাদ না যেতেন– এই কথাটা আমি কখনই না ভেবে থাকতে পারি না– এমন কাজটি তিনি না করলে– আমাদের কি অবস্থা হত আজ? আর যেহেতু তিনি আমেরিকায় গিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শুদ্ধ উপদেশ-বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে, তাই আজ পৃথিবীর সর্বত্র সবাই এই পরম মূল্যবান রত্নলাভের সুযোগ পেয়েছি।

ঠিক এই ধরনের চিন্তার আলোকে যে কেউ ব্যাপারটিকে যদি মন দিয়ে ভাবেন তো এই উপলব্ধি হবেই। মনে হবে “আমাদের গুরুদেবের মাধ্যমে কেবলই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী গ্রহণ করে চলি”– আর কোনই কথা নেই– শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যে কী অমূল্য রতœ দিয়েছেন, তার মূল্যের কোনও হিসাব-নিকাশ নেই। তাই সেটিকে লাভ করার জন্য কি না করা যায়। তবে মাঝপথে আমাদের সামনে দাঁড়ানো মায়াজটজালে বিভ্রান্ত হলে চলবে না।

কুয়াশার মধ্যে কিছু দেখা যায় না। নিজের হাতটাও ঘন অন্ধকারের মাঝে দেখা যায় না। সূর্য উঠলে তবে সব কিছু দেখা যায়। ঠিক তেমনি, আমাদের এই আন্দোলনের সামনে যে সব প্রবল বাধা বিপত্তি রয়েছে, সেই সমস্তই অবলীলাক্রমে ধ্বংস করে ফেলা যাবে যদি শুধুমাত্র শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শুদ্ধ রূপটুকু হৃদয়ে ধারণ করে থাকি। তিনি আমাদের যাচাই করছেন, ঠিক যেমনভাবে শ্রীল প্রভুপাদকে শ্রীকৃষ্ণ যাচাই করেছিলেন। অমন পরীক্ষায় কে পাশ করতে পারত! আমাদের সামর্থ্য মতোই অবশ্য পরীক্ষা হয়। আন্তরিকতা যদি আমাদের থাকে, যদি বিপরীত পন্থার সাথে কোনও রফা না করি, তবে আমাদের আর ভয়টা কীসের। কেবল কঠোরভাবে বিধিবদ্ধ নিয়মগুলি মেনে চলতে হবে।

হিমালয়ের দেশ নেপালে অনেকে যায় পর্বতে উঠে কৃতিত্ব অর্জনের জন্য। সেখানে অনেক সময় হঠাৎ পর্বতে বরফপাত শুরু হয়। তুষারধ্বস নেমে আসে। এই তুষার ধ্বসের কারণ জানতে গিয়ে দেখা যায়– আকাশ থেকে রাতে শিশির পড়ে সেগুলি জমে গিয়ে গড়িয়ে নামতে থাকে এবং ক্রমশ বড় হতে থাকে। তারপরে একটা বিরাট বাড়ির মতো বড় হতে থাকে। গড়াতে গড়াতে সেটি নিচে নামতে থাকে। শেষে একটা পর্বতের মতো হয়ে তার পতন ঘটে।

ঠিক এইভাবেই আমাদের কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী প্রচার করে চলেছে। কৃপার মহাখন্ড আমাদের হাতে। এম আশ্চর্য সেবা অধিকার আর কিসেই বা হতে পারে?

এমন সুযোগ কেউ ছাড়বেন না। এর থেকে বড় কাজ আর কি আছে? এর চেয়ে বড় বিস্ময়কর ব্যাপার আর কি হতে পারে? এই পরোপকার সেবায় কেউ অবহেলা করবেন না। মহাপ্রভুর অশেষ কৃপা রয়েছে এই মহাযজ্ঞে।

তুষার পর্বতে তুষারের পিন্ড ক্রমশ বড় হয়ে দ্রুতগতিতে নেমে আসতে থাকে। ঠিক তেমনিভাবে কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনও এগিয়ে চলেছে আর ক্রমশ বড় হচ্ছে এবং একদিন বিশালাকার ধারণ করে সমাজের ওপরে নেমে আসবে।

তাই আমাদের সকলকে এই আন্দোলনের মধ্যে দৃঢ়ভাবে থেকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী প্রচার করে যেতে হবে, এই হোক আজ আমাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন