প্রকৃত ভগবদ্ভক্ত নির্লোভ হন

 নারদ মুনি এতই কৃপালু যে, তিনি ধ্রুব মহারাজকে দীক্ষা দেবার পর শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত হবার পথও নির্দিষ্ট করে দিলেন- ভক্তি সেবা অনুশীলনের জন্য তিনি ধ্রুব মহারাজকে বৃন্দাবনের মধুবন নামক বনে যেতে নির্দেশ দিলেন। তাঁর ধ্রুব মহারাজের পিতার কথা মনে আসছিল, ভাবছিলেন– ছেলেকে হারিয়ে এক রকম বনবাসে পাঠিয়ে তাঁর পিতা হয়তো উদ্বেগে রয়েছেন। তাই তিনি বাবার সাথে দেখা করতে গেলেন, জানতে চাইলেন রাজকার্য কেমন চলছে, তাঁর দুঃখের কারণ কি?– ধর্মে, অর্থে, অর্থনৈতিক প্রগতিতে অথবা তাঁর ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধনে কোনও বিঘ্ন দেখা দিয়েছে কিনা।

এই জগতে সকলেরই প্রাথমিকভাবে ধর্মক্রিয়ায় নিযুক্ত থাকা প্রয়োজন। স্বাভাবিক নিয়মে ধর্মকর্ম করলে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আপনি আসে এবং অর্থনৈতিক সচ্ছলতা থাকলে ইন্দ্রিয়ের প্রয়োজনগুলি মেটানো যায়। শ্রীল প্রভুপাদ বলতেন, এখন যেহেতু আধুনিক পদ্ধতিতে লোকে সহজেই ইন্দ্রিয়তৃপ্তির উপায়গুলি পেয়ে যাচ্ছে, তাই বহু লোকে ধর্মনীতি ত্যাগ করছে। এর ফলে চরমে খুবই ভয়াবহ কর্মফলের শিকার হতে হয় এবং উপর্যুপরি দুঃখ-দুর্দশা নেমে আসে। সাধারণত মানুষ হতাশার শেষ পর্যায়ে পৌছে নির্লিপ্ত হয়ে পড়ে। তাকে বলে বিরক্তি মার্গ; সেটা ত্যাগ নয়। পূর্ববর্তী আচার্যগণ একটা উদাহরণ দিয়েছেন–

একজন অতি কৃপণ লোক ছিল। তার এক সুন্দরী কন্যা ছিল এবং লোকটি তার বিবাহ দিতে চাইছিল। কিন্তু বিবাহে দান সমাগ্রীতে সে মোটেই বেশি খরচা করতে রাজী ছিল না। তাই একটা মতলব করল– অতি সাধারণ জঙ্গুলে কাঠ দিয়ে একটা পালঙ্ক বানিয়ে এমনভাবে পালিশ করাল যাতে মনে হয় সেটা খুব সৌখিন এবং সেগুন কাঠ বা মেহগানী দিয়ে তৈরী। যারা অসত তাদের সে বলতে যে, যদি আমার মেয়েকে বিয়ে কর তা হলে এই সুন্দর নতুন পালঙ্কটি তোমায় উপহার দেব। গ্রামের দিকে এই রকম রীতি আছে যে, বিবাহের সময়ে ছেলেকে রোজগার করে জীবনধারণের উপযোগী কিছু সামগ্রী উপহার দেওয়া, যেমন শহরে মোট অঙ্কের চেক্ বা গহনা দেওয়া হয়।

তাই একটি গরিব লোক ভাবল, বেশ তো, একটা সুন্দর খাটই যদি পাওয়া যায় তো বিবাহ করি না কেন। তারপর কয়েক মাস পরে সস্তার খাটটি বেঁকে উঠতে উঠতে শেষে ভেঙেই পড়ল। এই লোকটি তখন ভাবল, আসবাবপত্র কেবল মিছা ভোগবিলাস, আমার চ্যাটাইটাই ভাল। যেহেতু তার খাট ভেঙ্গে গেছে তাই সে নতুন নীতি খাড়া করল যে, আসবাবপত্র ফালতু।




সেই জন্য শ্রীল প্রভুপাদ বলতেন, এটা কি ধরনের ত্যাগ? এই জগতে কেউই সুখী নয়। তারা তাদের ক্লেশকে ত্যাগ করছে। দুঃখ কষ্টকে ত্যাগ করতে অসুবিধা কোথায় অর্থাৎ এই জড় জগতে লোকে হতাশ হয়ে গেলে তখন ত্যাগ আসে, সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু বলী মহারাজের মুক্তির সময়ে শ্রীকৃষ্ণ বামনদেবকে বলেছিলেন যে, সব কিছু হারানোটা কোনও বিশেষ কৃপা নয়।

যার অগাধ ধনসম্পদ রয়েছে তার সব কিছুই আছে, কিন্তু তবু সেই সব থেকে সে অনাসক্ত হয়ে কৃষ্ণভাবনায় মগ্ন হয়ে থাকে– সেটাই ভগবানের পরম আশীর্বাদ।

কৃষ্ণভক্ত সুদামা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি এতই আসক্ত ছিলেন যে, জড়জাগতিক সুখ প্রদায়ক কোনও বরদানের প্রতি তার স্পৃহা ছিল না। তবু শ্রীকৃষ্ণের কৃপাশীর্বাদে সুদামা সব রকম জাগতিক সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন। তখন সেইগুলি কেবলই শ্রীকৃষ্ণের সেবায় কাজে তিনি লাগিয়েছিলেন।

যুধিষ্ঠির মহারাজ সমগ্র পৃথিবীর সম্রাট ছিলেন। কিন্তু তিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আসক্ত ছিলেন। কৃষ্ণ বিনা তাঁর সাম্রাজ্য ছিল শূণ্য। এটাই হল সত্যিকারের ভক্তি।

এখানে রাজা উত্তানপাদকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে তাঁর ক্লেশাদির কারণ কি। যেহেতু তিনি তাঁর পুত্র ধ্রুবকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাই তার খুবই খারাপ লাগছিল।

একসময় বাজশ্রবা নামে এক মহান রাজা ছিলেন, তাঁর পুত্র ছিল নচিকেতা। রাজা ধনসম্পদ লাভের জন্য যজ্ঞ করেছিলেন, এবং যজ্ঞের শেষে ব্রাহ্মণদের মুক্ত হস্তে দান করছিলেন। কিন্তু তিনি সেই সব গরু দান করছিলেন যেগুলি রোগা এবং দুধ দিতে পারে না। সেই দেখে নচিকেতা চিন্তিত হল, সে ভাবল, আমার বাবা যদি এই অকর্মা গাভীগুলি দান করে যান তাতে তাঁর কোন লাভ হবে না, ব্রাহ্মণরা তাঁকে অভিশাপ দেবেন। তখন সে বাবাকে বলল, বাবা আমকে একটা দান দেবে?

রাজা কর্ণপাত করলেন না। এইভাবে বারবার বলায় রাজা রেগে গেলেন। লোকে যখন রেগে যায়, বলে ‘যমের বাড়ি পাঠাব’। রাজা নচিকেতাকে বললেন, তোকে আমি যমের কাছে দান করলাম।

অতএব নচিকেতা স্থির করলে সে যমরাজের খোঁজে যাবে। যমরাজের বাড়ি পৌছে সে তিন দিন তিন রাত্রি অপেক্ষা করে রইল। যমরাজ ফিরে এসে দেখলেন, একি! একজন অতিথি অনাদরে আমার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে! এতে যে আমার অপরাধ হবে!

এখানে রাজা উত্তানপাদ নারদ মুনিকে অভ্যর্থনা সহ ঘরে এনে বসার আসন দিয়ে প্রণাম জানিয়েছিলেন। বৈদিক রীতি অনুসারে এইভাবে অতিথির সেবা করতে হয়। হঠাৎ কেউ বাড়িতে এসে পড়লে তাকে অতিথি-নারায়ণ বলা হয়, যেন নারায়ণ এসেছেন।

অতএব ধর্মরাজ হয়ে যমরাজ বুঝতে পারলেন যে, তাঁর অপরাধ হতে চলেছে। তখন তিনি নচিকেতাকে তিনটি বর দিতে চাইলেন। ছেলেটি বলল, প্রথমে এই বর প্রদান করুন যাতে বাড়ি ফিরে আমি দেখি আমার বাবা খুশির মেজাজে এবং সঠিক চিন্তাধারায় রয়েছেন, তিনি যেন আমার কাজে সন্তুষ্ট হন এবং জীবনে সিদ্ধি লাভের উপযুক্ত অবস্থায় থাকেন। যমরাজ বললেন, তথাস্তু।

আমার পরের ইচ্ছা হল, আমি সেই স্থানে যেতে চাই যেখানে সুখ-দুঃখ, ব্যাধি, মৃত্যু, সংগ্রাম ইত্যাদি কোনও রকম দ্বন্দ্ব নেই, যেখানে আলো বা অন্য কোনও জড় বস্তুর ওপর নির্ভর করতে হয় না, দিব্য জ্যোতি যে স্থান সর্বদা আলোকিত থাকে এবং সেখানে অপ্রাকৃত আনন্দানুভূতির সর্বোচ্চ স্তর সব সময় অনুভব করা যায়।

যমরাজ বললেন, দেখ, এই জড় জগতে ঐরকম জায়গা কোথাও নেই। একমাত্র বিষ্ণুলোকে তা পাওয়া যায়। সেখানে পৌছতে হলে তোমাকে জপ করতে হবে, শুধুমাত্র জ্ঞানের দ্বারা বা তপস্যার বরে সেখানে যাওয়া যাবে না, একমাত্র রাস্তা হল নিরন্তর ভগবানের দিব্য নাম কীর্তন করা।

ওঁ অথবা হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রের শব্দ তরঙ্গের দ্বারা ভগবান তুষ্ট হন– এই পথ আমি তোমাকে বলে দিলাম। তোমার তৃতীয় ইচ্ছাটি কি?

নচিকেতা বলল, শোনা যায় কেউ বলে আত্মা আছে, আবার কেউ বলে আত্মা নেই; আমি সত্যটা জানতে চাই, জীবনের আসল উদ্দেশ্যটা কি?

যমরাজ বললেন, এই প্রশ্নটা আমাকে কোরো না, আত্মা আছে, কি, নেই। তুমি একটা ছোট ছেলে এসব দ্বন্দ্বের মধ্যে তোমাকে যেতে  হবে না। আমি তোমাকে ধনসম্পদ, গৃহ, বাহন, দাস-দাসী, দীর্ঘ আয়ু, রাজত্ব, যা খুশি দিতে রাজী আছি, বল কি চাও।

নচিকেতা বলল, সে সবের শুরু আছে শেষ আছে তা নিয়ে কি লাভ; এর থেকে যে সুখ পাবো তাও তো ফুরিয়ে যাবে। লক্ষ বছর বাঁচলেও একদিন তো মরবই।

যমরাজ বললেন, তুমি তো দেখছি সাধরণ ছেলে নও, তুমি আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভের যোগ্য।

নচিকেতা বলল, আমি কোনও প্রশংসাও চাই না, আমি শুধু আত্ম-সম্বন্ধীয় সত্যটা জানতে চাই।

যমরাজ বললেন, সত্য জানতে হলে তোমাকে প্রকৃত গুরুর কাছে যেতে হবে। তাঁর কাছ থেকে তুমি জানবে যে, তুমি একটি চিরন্তন আত্মা পরম পুরুষ ভগবানের নিত্য সেবক, যিনি আমাদের হৃদয়ে পরমাত্মারূপে বিরাজ করছেন এবং অনাদিকাল আমরা তাঁর সেবা করে যেতে পারি।

এখানে আমরা দেখছি বাবা তাঁর ছেলেকে বললেন– যমের বাড়ি যাও, অবশ্য তিনি নির্দিষ্ট করে বলেছিলেন– যমরাজের কাছে যাও, বলেননি– উচ্ছন্নে যাও। ছেলে সোজা মৃত্যুরাজের কাছে পৌছে আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করে জড় জগৎ থেকে উদ্ধার পেয়ে গেল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন