পূণ্যনামের বন্যায় ভাসবে সবাই

 একজন আসুরিক ব্যক্তি বলতে পারে, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, আমি ঈশ্বরের সামনে প্রণাম করব না। কারোর সামনে আমি কখই প্রণাম করব না। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন যারা অসুর তাদের জন্য মৃত্যু রূপে ভগবান বিরাজ করেন। তারা যদি স্বেচ্ছায় ভগবানকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম না করে, তা হলে মৃত্যুকালে চিৎ হয়ে ঠাকুরের সামনে শুয়ে পড়তে হবে, প্রণাম করতে হবে– তা ইচ্ছাকৃতভাবেই হোক বা অনিচ্ছাকৃতভাবেই হোক।



আর দেহের মৃত্যুর পর আত্মা তো চিরকাল বেঁচে থাকে। পরের জন্ম কোন জায়গায় হবে তা বলার আমাদের অধিকার থাকে না। যেমন পাশ্চাত্য দেশে একটা ব্যবস্থা আছে যে, যারা ঘর থেকে বেরুতে চায় না, তাদের জন্য টেলিফোন গাইডের মতো একটা মোটা বইতে সমস্ত রকম জিনিসের নাম দাম বিবরণ দেওয়া আছে– জামাকাপড়, গাড়ি, খেলনা, বাড়ির কাজের জিনিস ইত্যাদি। তার থেকে পছন্দ করে ফোন করে দিলে বাড়িতে এসে দিয়ে যায়।

সেই রকম পরের জন্মে কি হব– দেবতা হব, না অসুর হব– এই রকম একটা জনমত নেওয়া হয়েছিল ইয়োরোপিয়ান সব ছেলে-মেয়েদের কাছে– কে কি হতে চান। তাতে অনেকে বলেছে, আমি বাঘ হতে চাই, বিড়াল হতে চায় ইত্যাদি। ওদের কাছে এটা খেলার মতো।

তবে দৈব প্রভাবে সেই রকম কিছু ইচ্ছা থাকলে– হতে পারে! পশু হতে পারে, গাছ হতে পারে– তার ওপর কোনও বিচার নেই, বিচার ভগবানের হাতে।

তাই যদি কেউ স্পর্ধা দেখায়, আমি যা ইচ্ছা করব, সে তো চিরকাল বেঁচে থাকতে পারবে না এই দেহ মধ্যে, মৃত্যুর পর ভগবান বিচার করবেন।

তবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপায়–

“পাপী তাপি যত ছিল

হরিনামে উদ্ধারিল

তার সাক্ষী জগাই মাধাইরে।”

শ্রীমায়াপুরে যখন বন্যা হয়েছিল, তখন চরিদিকে শুধু জল আর জল, নবদ্বীপ মায়াপুর সব ডুবে গিয়েছিল। সেই রকম, মহাপ্রভু বলেছেন, সমস্ত জগত আমি ভগবৎ প্রেমে প্লাবিত করে দেব।

জগৎকে প্রেমে প্লাবিত করা– আমাদের একটা অনুমান রয়েছে, প্লাবনটা কি জিনিস। প্লাবন মানে, পালাবার কোনও উপায় নেই। দু’এক জনের দোতলা চারতলা বাড়ি থাকলে তারা পালিয়ে থাকতে পারে। তেমই মহাপ্রভু দেখলেন তিনি যেখানে যেখানে গেছেন উড়িষ্যা, বিহার, বাংলা– সেই সব জায়গার সমস্ত লোক কৃষ্ণপ্রেমের জোয়ারে প্লাবিত হলেও কয়েকজন নির্বিশেষবাদী তখনও পালিয়ে রয়েছে, তারা এখনও প্রেম বন্যায় ডুবে যায়নি।

তখন মহাপ্রভু বললেন, ঠিক আছে, ওরা পালাতে চায় পালক কিন্তু আমার একটা পরিকল্পনা নিচ্ছি ওদের উদ্ধার করবার জন্য। তখন প্রকাশানন্দ সরস্বতী যিনি মায়াবাদী আচার্য ছিলেন বেনারসে কাশীতে তাঁর  কাছে গেলেন। সেখানে অনেক আচার্য সন্ন্যাসীরা এসেছেন। মহাপ্রভু দরজার কাছে যেখানে সব সন্ন্যাসীরা খালি পায়ে এসে পা ধুয়েছে– এ পা ধোয়া জলের মধ্যে উনি বসেছেন। প্রকাশানন্দ বলছেন– আপনি ওখানে কেন? তখন মহাপ্রভু শরীর থেকে জ্যোতি প্রকাশ করছিলেন এবং মায়াবাদীরা জ্যোতিটা খুব ভালবাসে। তারা জ্যোতি দেখে তার প্রভাব দেখে বলছে, আপনি এরকম নোংরা জায়গায় বসেছেন কেন?

মহাপ্রভু বলেছেন, আপনারা তো সব উঁচু স্তরের সন্ন্যাসী, আপনাদের সাথে কি বসতে পারি? আমি এখানেই বসি। তখন প্রকাশানন্দ তাঁকে তাঁদের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে বসালেন।

কেউ নিজে সেখানে বসতে চাইলে কি বসতে দিত? মহাপ্রভুর বিনয় ছিল একটা অস্ত্র। ঐ বিনয় দ্বারা তিনি একেবারে মাঝখানে পৌছেছিলেন। তখন ওরা সকলে মহাপ্রভুকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি তো আমাদের মতো একজন সন্ন্যাসী, তবে আপনি জনসাধারণের  সঙ্গে মিশে এরকম লীলা করেন কেন? কেন বেদান্ত পাঠ করেন না সন্ন্যাসীর মতো?

মহাপ্রভু তখন কিছু বলার অনুমতি চেয়ে বললেন, আমি কি করব, আমার গুরুদেব আদেশ দিয়েছেন, কলিযুগে হরেকৃষ্ণ নামই একমাত্র উপায়–

হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলম্।

কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা।।

হরিনামই হচ্ছে এই যুগের গতি। তাই আমি সকলের সাথে সংকীর্তন আন্দোলন করি। আর হরিনাম করতে করতে আমি পাগলের মতো হয়ে যাই, কথা আটকিয়ে যায়, কখনও হাসি, কখনও জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাই। এই অবস্থায় আমি গুরুদেবের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছি, আপনি কি মন্ত্র আমাকে দিয়েছেন– আমার মাথা ঘুরে যায়। এই হরিনাম করতে কি আমি ভুল করছি?

গুরুদেব বলেছেন, ভুল করবে কেন? এ সব তো হচ্ছে প্রেমের লক্ষণ। তোমার মধ্যে ভক্তি আছে বলে নাম করতে করতে তোমার মধ্যে এই ভাবগুলি প্রকাশিত হচ্ছে।

মহাপ্রভু বললেন, তাই আমি হরিনাম করছি। বলুন, এতে কোন দোষ আছে?

তখন তারা বলল, হরিনাম তো ভাল, কিন্তু বেদান্তসূত্র তো পাঠ করতে হবে সন্ন্যাসীদের। এই সুযোগ যখন মহাপ্রভু পেয়েছেন তখন আবার বিনয় প্রদর্শণ করে তাদের অনুমতি চেয়ে নিলেন কিছু বলার জন্য এবং মহাভারত থেকে ব্যাখ্যা করে এমন সুন্দর বেদান্তসূত্র পাঠ করলেন যে, সমস্ত বেদান্তিক সন্ন্যাসীরা মহাপ্রভুর শরণাপন্ন হয়ে পড়ল।

এইভাবে মহাপ্রভু সমস্ত জগৎকে ভগবৎ-প্রেমে প্লাবিত করেছেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন