পারমার্থিক বোনাস ‘কৃপা’

 শ্রীল পুভপাদ বলেছেন, দেবীধাম, হরিধাম, মহেশধাম ও গোলোকধাম– এই চারটি ধামই আমরা মায়াপুরে দেখতে পাই। ভাগবতে (৪/৬/৮-৪২) মহেশধামের বিশদ বর্ণনা দেওয়া আছে। কৈলাস হল শিবের আবাসস্থল। স্বর্গীয় গ্রহলোকগুলি থেকে দেবতারা যখন কৈলাসে আসেন, তাঁরা চমৎকৃত হয়ে যান। ব্রহ্মলোকেরও উর্ধ্বে শিবের এই আবাসস্থল এই কৈলাস। হিমালয়ে কৈলাস নামে একটা জায়গা আছে, সেই এই কৈলাসেরই বিস্তার।

কৈলাসের প্রাকৃতিক বর্ণনা ভারি সুন্দর- বিভিন্ন রকমের ফলের গাছ, ফুলের গাছ, ওষধি গাছ-গাছড়া, জলপ্রপাতের মাঝে বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখিও বাস করে সেখানে। সে যেন প্রাকৃতিক শিল্পকলার এক নিদর্শন। এ সবই শিবের পরিকল্পনায় সৃষ্ট।

ভগবান বিষ্ণু যখন তাঁর ত্রিবিক্রমরূপে ব্রহ্মান্ডের আচ্ছাদন ভেদ করেন, তখন কারণ সমুদ্রের জল গঙ্গা রূপে বাহিত হয়ে ব্রহ্মান্ডে প্রবেশ করে এবং শিব সেই জলরাশি তাঁর মস্তকে ধারণ করেন। সেইখান থেকে গঙ্গা বিভিন্ন গ্রহলোকে প্রবাহিত হয়। অতএব গঙ্গা কারণসমুদ্র থেকে মহেশধাম হয়ে দেবলোক– আদি চৌদ্দ ভুবন বয়ে চলেছে– যেটি এখন আমাদের মায়াপুরে চন্দ্রোদয় মন্দিরের এত কাছ দিয়ে বঙ্গোপসাগরে, এবং সেখান থেকে আরও অন্যান্য স্থানে বয়ে চলেছে।

এটা শুধুই জল নয়; এটা পারমার্থিক জলের ধারা, দিব্য বারি। আমরা দেখি গঙ্গার একাংশের জল বাংলাদেশে পদ্মা নদীতে চলে গেছে, কিন্তু শাস্ত্র বলে গঙ্গার এই পবিত্র জল পদ্মায় যাচ্ছে না, তা এই ভাগীরথী দিয়ে বইছে।

যেসব লোকেরা বৈষ্ণবদের সম্মান করে চলেন, তাঁরাই এই জগতের সবচেয়ে ভক্তিমান শ্রেণী। সেই রকমই প্রত্যেক নদী, প্রত্যেক উৎসব, প্রত্যেক জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব আছে। গঙ্গায় স্নান করা মাহাত্মপূর্ণ যেহেতু অন্য কোথাও স্নানের চেয়ে এখানকার স্নানের ভিন্ন প্রভাব পাওয়া যায়। এখানে উল্লেখ রয়েছে যে, বিশেষ কয়েকটি দিনে (যেমন গৌরপূর্ণিমা) গঙ্গাদেবী বিশেষ কৃপা প্রদায়িনী হন।

ভীষ্মপঞ্চক বলে একটি অনুষ্ঠান– কার্তিক মাসের উত্থান একাদশী থেকে শুরু হয়ে পাঁচদিন চলতে থাকে। এই পাঁচদিন যাঁরা অনুকল্প বা শস্য গ্রহণ বর্জন পালন করেন, তারপর অন্যান্য যজ্ঞাদির সাথে রাধাকৃষ্ণের পূজা করেন, তাঁরা অতি বিশেষ কৃপালাভে সমর্থন হন, এই পাঁচদিন তাঁদের জন্য থাকে বিশেষ অতিরিক্ত আশীর্বাদ।

এক দেশে খুব সাদাসিধে একটি লোক ছিল। সে নানা স্থানে ভ্রমণ করত। কুসঙ্গে পড়ে তার পতন হয়েছিল। আমিষ আহার, বিভিন্ন আসব পান ইত্যাদি নানা ভোগ্যবস্তুর প্রতি সে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল– যেসব কাজে পতিত লোকেরাই অভ্যস্ত। অতএব তার সঙ্গীরা তার সঙ্গ ত্যাগ করে চলে গেল, এবং সে যত রাজ্যের জঘন্য ক্রিয়াকলাপে মেতে উঠল।

একদিন সকালে অভুক্ত অবস্থায় ঘুরতে ঘুরতে সে কিছু ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবগণের দেখা পেল, তাঁরা যজ্ঞ করছিলেন। সে গিয়ে বলল, আমি ক্ষুধার্ত, কিছু খাবার পেতে পারি? অনেক দূর থেকে আসছি।

তাঁরা বললেন, তুমি কে? এখন খেতে চাইছ কেন? জান না আমরা আজ সবে ভীষ্মপঞ্চক ব্রত শুরু করেছি? আমাদের সাথে তুমি পাঁচদিন উপবাস পালন কর– পাঁচদিন শস্যাদি বর্জন করে ফলমূল আহর গ্রহণ করে শ্রীকৃষ্ণের পূজা করলে তুমি কত আশীর্বাদ পাবে!

সে তখন সিদ্ধান্ত করল, ঠিক আছে, আমাকে আপনাদের সঙ্গে এই যজ্ঞে অংশগ্রহণ করতে অনুমতি দিন এবং আমার এই পতিত অবস্থা থেকে আমাকে কৃপা করে উদ্ধার করুন।

এইভাবে সে ব্রাহ্মণদের সেবা করে শুদ্ধ হয়ে ভগবানের ভক্ত হয়ে গেল এবং তার জীবনের শেষে বিষ্ণুদূতরা বিশেষ আকাশযানে চড়ে এসে তাকে দিব্য শরীর দান করে সোজা গোলোকধামে নিয়ে চলে গেল। তো, এইরকমই, ভক্তদের গোলোকধামে ফিরে যাবার জন্য সেই ভাবে ভাবতে হয় না, তাদের যা করণীয় তা হল সর্বক্ষণ শ্রীকৃষ্ণকে খুশি করার চেষ্টা করা। সব একাদশী পালন, জন্মাষ্টমী, গৌরপূর্ণিমা উদযাপন, গুরুপূজায় অংশগ্রহণ, গুরুর আদেশ পালন, ভগবানের পূজা করা– এইগুলি বছরে ৩৬৫ দিন পালন করলে ভক্ত আপনিই সব যজ্ঞের ফল প্রাপ্ত হতে পারে।

কিন্তু লোকে সহজে উপরি পাওনা পেতে চায়– রাসপূর্ণিমায় তারা দল বেঁধে মায়াপুরে আসে, এলাহাবাদের কুম্ভ মেলায় লক্ষ লোক সমাগম হয় কারণ ঐ সময়ে ত্রিবেণী সঙ্গমে স্নান করতে পারলে একটু বেশি কৃপা লাভ করা যায়। ভক্তরা কিন্তু সেখানে যান সাধুসঙ্গ করার উদ্দেশ্যে। ঋষিতুল্য ভক্তদের সঙ্গ করার জন্য এবং প্রচার করার জন্য এটা একটা বড় সুযোগ।

শ্রীকৃষ্ণ যেহেতু সকলের পিতা, মায়াপুর ধামও সকলের বাড়ি। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের স্বপ্নে দেখা এক দিব্য নগরীর একটা বিবরণ আছে– বিশাল মন্দির, অপূর্ব সব গাছপালা, বাগান ইত্যাদি রয়েছে সেখানে। দিব্য নগরীকে দিব্য পর্যায় থেকে আমাদের কাছে দৃশ্যমান পর্যায়ে পুনঃপ্রকাশ করতে হবে। অস্তিত্ব তার রয়েছেই– উচ্চ মাত্রায় রয়েছে। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর তার দর্শন পেয়েছিলেন, নিত্যানন্দ প্রভু তা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তার অস্তিত্ব  রয়েছে, এখন আমাদের তা প্রকাশিত করে তুলতে হবে– তার সুবর্ণ সুযোগ আমাদের রয়েছে।



অবশ্য সকলের সহযোগিতাও আমাদের দরকার। এখানে কৈলাসের বর্ণনায় আমরা দেখছি দিব্য নগরীতে কত গাছপালা বাগান রয়েছে। আমাদেরও ঐ রকম নগরী বানাতে হবে। ভক্তরা গাছ লাগাবে– ফলের গাছ, ফুল গাছ– ইঁটকাঠের বাড়ি দিয়ে ভিড় করলে চলবে না। এটা হবে শ্রীশ্রীরাধামাধবের কাছে আমাদের নিবেদন। তাঁরা হলেন ‘কুঞ্জবিহারী’– বনে বসে থাকতে তাঁরা আনন্দ পান। তাই আমরা এই গুপ্ত-বৃন্দাবন (মায়াপুরে) সুসজ্জিত বন তৈরী করতে চাই যাতে তাঁরা এইসব কুঞ্জে এসে উপভোগ করতে পারেন।

শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর শিষ্য ও অনুগামীদের শুধু ভক্তিমূলক চিন্তা করতেই বলতেন না, তিনি উৎসাহ দিতেন কিভাবে বাস্তবে আমাদের চিন্তাভাবনা, বাক্য, কাজকর্ম, সবকিছু ভক্তিমূলক কাজে লাগাতে পারি। গুরুদেবের, পূর্ববর্তী আচার্যদের, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর ও তাঁর পার্ষদদের এবং শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের মনোগ্রাহী ভক্তিমূলক কাজে আমাদের বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারই তার উপযুক্ত সদ্ব্যবহার।

ভগবানের আশ্চর্য সৃষ্টি, তাঁর এবং তঁর ভক্তদের অপ্রাকৃত উপস্থিতি– এইসব সম্বন্ধে সবাইকে বই পড়তে হবে। আমাদের কাজকর্ম অনেক সময় জাগতিক মনে হলেও শ্রীল রূপগোস্বামী বলেছেন, যা-কিছুই কৃষ্ণচেতনা বৃদ্ধি করবে তা-ই উন্নতি বৃদ্ধি করবে। তা হবে বিষ্ণুর জন্য কর্ম। এখানে মায়াপুরে আমরা ছাপাখানায় প্রভুপাদের গ্রন্থ প্রকাশ করছি– এই পারমার্থিক কাজ প্রভুপাদের খুব প্রিয়। এখন বাংলা ভাষায় শ্রীমদ্ভাগবত প্রকাশিত হওয়ায় আরও বহুজন আধ্যাত্মিক সত্য উপলব্ধি করার সুযোগ পাবে। কত লোক এখানে আসছে। তারা এবং মন্দিরের ভক্তরাও সকালের সাধনায় জপক্লাসে, পাঠে অংশগ্রহণ করে, পুরাণের কাহিনী শুনে আধ্যাত্মিক লাভ পাচ্ছে। এইভাবে ভক্ত এবং অতিথিরাও ভগবৎ-কথা শ্রবণ করে। মন্দির দর্শন করে আপনা-আপনিই বিশেষ উপরি কৃপা লাভ করে ফিরছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন