পাপ-পুণ্যের জমা খরচের হিসাব

 আমরা যখনই সুখ ভোগ করি, তখনই উপলব্ধি করা উচিত যে, আমাদের প্রারব্ধ শুভ কর্মফলের পরিণামেই সেই সুখ ভোগের সুযোগ দিয়েছেন ভগবান। তবে সুখ ভোগ করার সঙ্গে সঙ্গেই সেই সঞ্চিত পুণ্যফল ক্ষয় হতে থাকে। ধ্রুব মহারাজের মতো মহাত্মাও ভগবানের এই আইনের বাইরে যেতে পারেননি।



অধিকাংশ লোকেই যখন সুখ উপভোগ করে, তখন মনে করে, এমনটাই চলতে থাকলে বেশ ভাল হয়। কিন্তু জমানো টাকা খরচ করতে করতে যেমন এক সময়ে তা ফুরিয়েই যায়, পূর্ণকর্মের ফল স্বরূপ সঞ্চিত সুখ উপভোগও একসময়ে শেষ হয়ে যায়। তখন দুঃখ আসে।

এই জমা-খরচের হিসাব ঠিক রাখার জন্যই সুখ ভোগের সাথে সাথেই পুণ্য কর্মফলের হিসাবে কিছু কিছু জমা করার জন্য তপশ্চর্যা নিয়মিতভাবে পালন করে চলতে হয়। এই তপশ্চর্যাগুলির মধ্যে প্রধান চারটি হল– যৌন সংযম, মাছ মাংস বর্জন করে শুধু প্রসাদ আহার, দ্যূতক্রীড়া বর্জন এবং আসবাদি নেশা পরিহার।

এ ছাড়া অন্যান্য তপশ্চর্যা হল প্রতিমাসে দু’বার একাদশী তিথিতে শুদ্ধ সাত্ত্বিকভাবে উপবাস ব্রত উদ্যাপন এবং চাতুর্মাস্যে (আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র এবং আশ্বিন এই চার মাসে) যথাক্রমে শাক, দই, দুধ এবং বিউলি ডাল ভোজন বর্জন করতে হয়। এইগুলির মাধ্যমে মানব দেহে অত্যধিক পরিমাণে প্রোটিন সঞ্চয় নিয়ন্ত্রনের বিধি বৈদিক যুগ থেকে প্রচলিত রয়েছে। তার ফলে মানুষ সুস্থ নীরোগ দীর্ঘ জীবন যাপনের সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে এবং তার পুণ্যকর্মফল সঞ্চিত হয়। তবে সাধারণ মনুষ দান ধ্যান আর তীর্থ ভ্রমণের মাধ্যমে পুণ্য সঞ্চয়ের যে চেষ্টা করে থাকে, সেটাই সব নয়।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য যা করা হয়, তার মাধ্যমেই যথার্থ পুণ্য সঞ্চয় হয়ে থাকে। এই জন্য ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন নিয়মিতভাবে করা উচিত। শ্রেষ্ঠ পুণ্য সঞ্চয়ের সেটাই সহজতম পদ্ধতি। কেবলমাত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবার অনুকূল কাজ করতে থাকলেই নিরন্তর পুণ্য সঞ্চিত হতে থাকে।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই কারণেই আমাদের উপহার দিয়েছেন ভক্তি, যার মাধ্যমে চিন্ময় আনন্দ লাভ হয়। ধ্রুব মহারাজ ছত্রিশ হাজার বছর সার্থকভাবে পৃথিবী শাসন করেছিলেন, কেবলই ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য এবং জনগণকে ভগবদ্মুখী করে তোলার জন্য। কলিযুগে ভগবানের বিধানের জন্য আমাদের চাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপাশীর্বাদ। তাঁর কৃপায় সামান্য মাত্র ভগবদ্ভক্তির চর্চা করলেই দিব্য আনন্দ লাভের পথ প্রশস্ত হতে থাকে এবং সর্বপ্রকার অশুভ কর্মের কুফল নাশ হতে থাকে।

যারা এই সব সদুপদেশ মানে না, তারা নিজেদের বড়ই বাস্তববাদী মনে করে বড়াই করে থাকে। তারা মনে করে, জীবনটাকে যেমন-তেমনভাবে উপভোগ করে নেওয়াটাই মানবধর্ম। তাই তারা তপশ্চর্যা করতে চায় না। তাই প্রকৃতপক্ষে তারা মোটেই বাস্তববাদী নয়, তারা মায়াবাদী-জগতের মায়ামোহের আচ্ছন্ন হয়ে তারা যা খুশি খায়, যেমন খুশি চলে, যা মুখে আসে তাই বলে চলে। তাদের দুঃখ-দুর্দশার হিসাবের বোঝা সেই জন্য বাড়তেই থাকে।

এই প্রসঙ্গে অঙ্গুলিমালের কাহিনীটি যথার্থই তাৎপর্যপূর্ণ। এক দস্যু সমস্ত গৃহস্থের সর্বস্ব অপহরণ করে নিয়ে তাতেও সন্তুষ্ট হত না– অপহরণের শেষে গৃহস্থের কণিষ্ঠাঙ্গুলিটি নিষ্ঠুরভাবে কেটে নিয়ে আসত এবং সেই আঙ্গুলটিকে মালায় গেঁথে গলায় ঝুলিয়ে রাখত। ঐ দস্যুটির দলের সকলেই ঐভাবে গৃহস্থের সর্বস্ব অপহরণ করার পরে, তার কনিষ্ঠাঙ্গুলিটিকে নিয়ে গলায় মালার মতো ঝুলিয়ে রাখত কৃতিত্বের নিদর্শন স্বরূপ। যে-দস্যুর গলার অঙ্গুলিমালা যত দীর্ঘ হত, তার নিষ্ঠুরতা আর পাপকর্মের কৃতিত্ব তত বেশি বলে দস্যুদলে পরিগণিত হত।

ঘটনাক্রমে সেই দুস্যদলপতি অঙ্গুলিমালা একদা ভগবান বুদ্ধদেবের সান্নিধ্য লাভ করেছিল এবং তার ফলে সে তার জঘন্য পাপকর্মের ভয়াবহ কুফল সম্পর্কে উপলব্ধি অর্জনে সক্ষম হয়, অতঃপর দস্যুবৃত্তি পরিহার করে বৌদ্ধ ভিক্ষুরূপে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বনের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করাই শ্রেয় মনে করেছিল।

এইভাবে দস্যু অঙ্গলিমাল পাপজনিত কর্মফল থেকে অব্যাহতি পাওয়ার বাসনায় যখন গৃহস্থদের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে পুণ্যসঞ্চয়ের প্রয়াসী হয়, তখন একদিন সে কোনও এক গৃহস্থের বাড়িতে গিয়ে ভিক্ষা গ্রহণের সময় লক্ষ করে যে, সেই গৃহস্থটির হাতের কনিষ্ঠাঙ্গুলিটি নেই।

তখন সহসা অঙ্গুলিমালের বিচলিতভাবে জাগে এবং সে বুঝতে পারে, অতীতে তার পাপ অনুশীলনের জীবনে সে নিশ্চয়ই এই গৃহস্থ বেচারির হাতের আঙ্গুল কেটে নিয়েছিল।

ইতিমধ্যে সেই গৃহস্থটিও ভিক্ষুকে ভিক্ষা দানের সময়ে চিনতে পারল যে, সেই ভিক্ষুটিই একদা দস্যুরূপে তার সর্বস্ব অপহরণ করে তাকে নিঃস্ব করে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল।

সুতরাং চকিতের মধ্যে ভিক্ষুর প্রতি গৃহস্থটির মনোভাবের পরিবর্তন দেখা দিল। প্রতিশোধের অদম্য স্পৃহা এবং পূর্বস্মৃতিজনিত ভয়াবহ ভীতি তার মনে এক প্রবল হিংস্র ভাব জাগিয়ে তুলল। ফলে, সেই গৃহস্থ তৎক্ষণাৎ সেই ভিক্ষুবেশী পুরাণো পাপী দস্যু অঙ্গুলিমালকে বেদম প্রহার করতে শুরু করে দেয় এবং এইভাবে সে তাকে বধ করে।

এই ঘটনার পর অন্যান্য বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভগবান বুদ্ধের সমীপবর্তী হয়ে বিনীতভাবে জানতে চায়, অঙ্গুলিমাল তার পূর্বকৃত পাপকর্ম সমস্ত পরিহার করে সম্পূর্ণভাবে ভিক্ষুজীবন যাপন করা সত্ত্বেও তাকে ঐভাবে নিগৃহীত হতে হল কেন? তবে কি ভিক্ষুজীবনের সঞ্চিত পুণ্যকর্মের কোনই মূল্য নেই?

এই তাৎপর্যপূর্ণ চিরন্তন প্রশ্নটির উত্তর প্রদান প্রসঙ্গে ভগবান বুদ্ধ তখন যে উপদেশ প্রদান করেছিলেন, তার সারমর্ম ছিল এই যে, পুণ্যকর্ম করে প্রারব্ধ পাপকর্মের ফলভোগ থেকে রক্ষা বিন্দুমাত্রও পাওয়া যায় না। পুণ্য কর্ম করলে তার সুফল যেমন সঞ্চিত থাকে, পাপকর্মের কুফলও তেমনই যথাযথভাবে সঞ্চিত হয়ে থাকে, তা ক্রমান্বয়ে জীবমাত্রেরই ভোগ করার বিধি চিরন্তন।

কেউ যদি মনে করে, জন্মে-জন্মে এবং ইহজন্মে যত পাপকর্ম সে করেছে, তার কুফল ভোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য প্রচুর পরিমাণে পুণ্যকর্ম করতে থাকলেই পাপকর্মের কুফল কমতে থাকবে, তা হলে তাকে এই অঙ্গুলিমালের কাহিনী স্মরণ করতে হবে।

জীবনে যে কোনও পাপকর্ম করলেই তার পরিমনামগত কুফল সঞ্চিত থেকে যায় এবং পাপীকে তা কোন না কোনও প্রকারে ভোগ করতেই হয়– তা থেকে কোনও মুক্তিলাভের অবকাশ থাকে না। পুণ্যকর্ম দিয়ে পাপকর্মের কাটাকুটি খেলা চলে না। এটাই জড়া প্রকৃতির কঠোর নিয়ম। কিন্তু শুদ্ধ ভক্তিমূলক সেবা পাপ ও পুণ্য ফলকে সম্পূর্ণ ক্ষয় করে দিতে পারে।

সুতরাং পাপকর্ম থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকার মতো জীবনধারা অনুসরণ করাই সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমানের কাজ বলে শাস্ত্রসমূহে নির্দেশিত হয়েছে এবং তাই হচ্ছে শুদ্ধ ভক্তির অনুশীলন। যারা শাস্ত্রীয় অনুশীলনাদি জানে না কিংবা জানলেও জড়জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের অহঙ্কারে শাস্ত্রীয় অনুশাসন মানে না, তারা বুক ফুলিয়ে প্রকাশ্যে পাপকর্ম করে থাকে এবং অবধারিতভাবেই একদিন দস্যু অঙ্গুলিমালের মতোই সর্বজনসমক্ষে পাপের ফল ভোগ করে। তার কোনরকম অন্যথা হয় না। ইহজন্মে না হোক, পরজন্মেও এমন কি বহু জন্ম-জন্মান্তর ধরেও, সঞ্চিত পাপকর্মফল ভোগ করে চলতে হয়।

তেমনি পুণ্যকর্মের ফলও সঞ্চিত থাকে এবং ইহজন্মে ও জন্মজন্মান্তর ধরে তার সুফল ভোগ করা চলে। এই পুণ্য ফলও এক শক্ত বন্ধন। তাই বুদ্ধিমান মানুষমাত্রেই এই বিবচেনায় ভক্তি-জীবন যাপন করে সর্বদাই পাপ এবং পুন্য উভয় প্রকার ফলের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়। অঙ্গুলিমাল ভিক্ষু-জীবন গ্রহণ করে পুণ্য সঞ্চয় করেছিলেন, কিন্তু তিনি শুদ্ধ ভক্তিজীবন গ্রহণ করেননি বলে তাঁকে শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল। পাপ এবং পুণ্যের ফল যদিও পরস্পরকে প্রভাবিত করে না, কিন্তু শুদ্ধ ভক্তিমূলক সেবায় নিযুক্ত হলে উভয় প্রকার কর্ম-বন্ধনই ক্রমে ক্রমে নিঃশেষিত হয়ে যায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন