সমাজকে হতে হবে কৃষ্ণমুখী

 


মাঝে মাঝে দেখা যায় পিতা-মাতারা তাঁদের সন্তানদের ভুল পথে চালিত করছেন। নচিকেতার বাবা তাকে বলেছিলেন, ‘যমের বাড়ি যাও।’ আবার ধ্রুব মহারাজের মা তাকে বনে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু যে বাবা-মা তাঁদের সন্তানকে শ্রীকৃষ্ণের কাছে যেতে বলেন, তাঁরাই প্রকৃত বাবা-মা। যে গুরু আমাদের শ্রীকৃষ্ণের কাছে নিয়ে যেতে পারেন, তিনিই প্রকৃত গুরু। তেমনই যে রাজা, নেতা বা শিক্ষক শ্রীকৃষ্ণের সন্ধান দিতে পারবেন তিনিই প্রকৃতপক্ষে সম্মানীয়। শ্রীমদ্ভাগবত অনুসারে তাই শ্রীল জীব গোস্বামী বলেছেন যে, যাঁরা শ্রীকৃষ্ণের কাছে আমাদের নিয়ে যেতে পারেন না, তাঁরা বাবা নন, মা নন, গুরু নন বা নেতা বা শিক্ষক নন। তাই শ্রীমদ্ভাগবতের চতুর্থ স্কন্ধের অষ্টম অধ্যায়ে আমরা দেখি যে, রাজা উত্তানপাদ ধ্রুবের প্রতি সঠিক পিতৃদায়িত্ব পালন করতে না পারার জন্য আক্ষেপ করছেন।

জড় জগতে আমরা সকলে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করছি। কিন্তু শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ এবং তাঁকে যিনি পাঠিয়েছেন– সেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপায় আমরা জানতে পেরেছি পরম উদ্দেশ্যটি কি। এটা খুবই দুর্লভ। লোকে কেবল অর্থনৈতিক উন্নতি আর ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধনেই ব্যস্ত। অল্পসংখ্যক লোক মুক্তি চায়, যেটা হল চতুর্থ সিদ্ধি। পঞ্চম সিদ্ধি হল- শুদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম লাভ।

কৃষ্ণভক্তি সকলের জন্য, এমন কি নরাধমও তার যোগ্য। শুদ্ধ ভক্তিতে সব রকম জাগতিক আত্মপরিচয় থেকে মুক্ত হতে হয় যে, আমি নারী, আমি পুরুষ, আমি গরিব, বড়লোক, বৃদ্ধ, যুবক ইত্যাদি। কারণ “জীবের স্বরূপ হয় নিত্য কৃষ্ণদাস।” শ্রীল প্রভুপাদ যখন আমেরিকায় গিয়েছিলেন, তাঁকে বলা হয়েছিল– আপনি আমাদের মতো ধনী দেশে ভারতীয় সংস্কৃতি আনছেন কেন? শ্রীল প্রভুপাদ বলেছিলেন, তোমরা আমেরিকান নও, খ্রিষ্টান নও, ভারতীয় নও- তোমরা চিন্ময় আত্মা। এটি হল সব চেয়ে বড় জ্ঞান– পরম গুহ্য জ্ঞান।

ঠিক একই ভাবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও চেয়েছিলেন মানুষের চিন্তাধারা বদল করতে। নারদ মুনির অনুরোধে মহাপ্রভু তাঁর সমস্ত পার্ষদের, গোপীদের, দ্বারকার মহিষীদের সাথে নিয়ে অবতরণ করলেন। তিনি বললেন, আমি শচীমাতার গর্ভে জন্ম নিয়ে সকলকে কৃষ্ণপ্রেমে প্লাবিত করব। আর যদি কেউ খুব দূরে পশ্চিমে কোথাও পালিয়ে যায়, তা হলে আমি ভগবানের ভক্তসেনাপতিকে পাঠাব তদের উদ্ধার করে আনতে।

অতএব নারদ মুনি শ্রীবাস পন্ডিত রূপে আবির্ভূত হলেন, এবং শ্রীচৈতন্যদেব এলেন তাঁর কৃপা বিতরণ করতে। অবশ্য আমরা যদি নিজেরাই ফলটি খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তবে বিতরণ কাজটা খুব ভাল করে হবে না। ফল আস্বাদন এবং বিতরণ দুই-ই একসাথে করতে হবে।

পৃথিবীতে সবাই যাতে মুক্তি পায় সেই জন্য শ্রীল প্রভুপাদ বিশেষ উদ্বিগ্ন ছিলেন। ঠিক এই জিনিসটাই আমাকে স্পর্শ করেছিল ১৯৬৮ সালে যেদিন আমি মন্ট্রিলে প্রথম শ্রীল প্রভুপাদের সাক্ষাৎ পাই– তিনি বলেছিলেন, আমার এত বয়স হয়ে গেছে আমি সাহায্যের লোক চাই। এই দুঃখ-দুর্দশার জগৎ থেকে মানুষকে উদ্ধার করতে কে আমাকে সাহায্য করবে?

আর শ্রীল প্রভুপাদ এখনও ঐ রকমভাবে ডাকছেন। তবে এখন লোকে অনেকটাই নিরামিষ আহারের দিকে ঝুঁকছে, কিছু কিছু পূজা অর্চনা মানছে এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে শাস্ত্রসম্মতভাবে সহনশীল হয়ে উঠেছে। এখন আমরা শ্রীল প্রভুপাদকে বলতে পারি– কিরকমভাবে বড় অফিসাররা, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতারা ধ্যান জপের জন্য সময় রাখেন, যেটা পঁচিশ বছর আগে দেখা যেত না। তবে আরও কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের কাজ হবে তাদের ধ্যান-ধারণাগুলির অস্পষ্ট নিরাকার বিষয় থেকে ঘুরিয়ে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রের দিকে আনা, জপমালায় জপ করতে শেখানো।

শ্রীল প্রভুপাদ চাইতেন– সকলে যেন অংশগ্রহণ নিতে পারে, গরিবদের জন্য তিনি প্রসাদ বিতরণ ‘ফুড ফর লাইফ’ অর্থাৎ জীবনদায়ী খাদ্য বিতরণের আয়োজন করেছেন, ধনীদের জন্য ‘আজীবন সদস্য’ পরিকল্পনা করেছেন শ্রীকৃষ্ণের সেবায় অর্থ সংগ্রহ করতে। কেউ যেন বাদ না যায়।

একবার আমি কলকাতায় স্বপ্ন দেখেছিলাম– যেখানে আমাদের রথযাত্রা উৎসব হয়, অনেক লোক, রাস্তায় জঞ্জাল, যে শহর আগে ইংরেজদের সময়ে ভারতের রাজধানী ছিল। তারপর দেখলাম দ্বারকা– সব লোকেরা জপ কীর্তন করছে, হাতে মালা, কপালে তিলক, পরিচ্ছন্ন পোশাক পরা। কৃপা হলে এই সবই সম্ভব, কলকাতাও দ্বারকা হয়ে যেতে পারে, এবং জগন্নাথদেব রয়েছেন– কেন নয়! নিউ ইয়র্কও নিউ দ্বারকা হতে পারে। এইভাবে সারা বিশ্বেই আমরা পবিত্র ধাম রচনা করতে পারি।

মায়া আমাদের নানা রকমে ঠকাতে চেষ্টা করবে। কিন্তু আমাদের দৃঢ়সঙ্কল্প থাকতে হবে, এবং মনে রাখতে হবে যে, শ্রীকৃষ্ণ তাকেই সাহায্য করেন, যে তাঁর সেবা করে। প্রত্যেকের পারমার্থিক জীবনেই বাধা-বিপত্তির পরীক্ষা আসবে। যত আমরা সেগুলি পেরিয়ে আসব, ততই আমরা আরও বড় বাধা পেরোতে সক্ষম হয়ে উঠব, এবং সব শেষে সবচেয়ে বড় বাধা মৃত্যুকে জয় করে আমাদের প্রকৃত আলয় শ্রীকৃষ্ণের কাছে ফিরে যাব।

তাই শ্রীল প্রভুপাদ প্রতি মুহূর্তে কার্যকরী ক্ষেত্রে আমাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন বৈষ্ণবদের সেবা করতে, গুরুপরম্পরার সেবা করতে এবং বাধা বিপত্তি অতিক্রম করার শক্তি সংগ্রহ করতে। এই ব্রত সাধনে ভক্তদের কৃপাই আমাদের সম্বল। অনেকে বলে, সব কিছুই ভগবানের দয়ায় হবে– সেটা হল বেড়াল-ছানা তত্ত্ব। কোন দার্শনিক বলে, সব কিছুই নিজের চেষ্টার দ্বারা সফল হয়– সেটা হল বানর-ছানা তত্ত্ব।

মা-বেড়াল তার ছানাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ছানা ভাবে– ‘আমি কিছুই করতে পারি না, ভগবান সব করে দেবেন।’ খ্রিস্টানরাও ঐরকম। তারা ভাবে– ‘আমি ইন্দ্রিয় সংযম করতে পারি না, আমি কিছু করতে পারি না, আমি নিজের মত সব করে যাব, কিন্তু ঈশ্বরের কৃপায় নির্ভর করে থাকব।’

আর এক দল লোক আছে যারা বলে, ‘ভগবানকে আমার দরকার নেই, গুরুর কি প্রয়োজন, নিজের চেষ্টাতেই সব হবে।’

কিন্তু আচার্য ব্যক্তিরা বলেন,– আমরা অন্ধকূপে পড়ে গেছি, এবং শ্রীকৃষ্ণ গুরুপরম্পরায় তাঁর ভক্তদের মাধ্যমে দড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আমরা নিজেরা কুঁয়ো থেকে উঠতে পারি না। দড়ি ধরতে হবে, তাঁরা টেনে তুলবেন তবে উঠতে পারব। কিন্তু আমাদের চেষ্টারও প্রয়োজন আছে, ভক্তের সহযোগিতারও প্রয়োজন।

শ্রীল প্রভুপাদ আমাদের উপায় দেখিয়ে দিয়েছেন, সেবাগুলি অনুশীলন করতে হবে। এইভাবে সফলতা আসবেই– শ্রীকৃষ্ণ নিজে আশ্বাস দিয়েছেন, ‘মা শুচঃ’, দ্বিধা করো না, তুমি অবশ্যই আমার কাছে ফিরে আসবে।

সমাজের ভাবটা এই রকম হওয়া উচিত যে, সকলকে কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে উঠতে সাহায্য করা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন