কৃষ্ণকৃপা দরকার

 



ব্রহ্মা কৃষ্ণের সঙ্গী বালকদের ও গোবৎসদের লুকিয়ে রেখে এসে দেখলেন কৃষ্ণের সঙ্গে আগের মতোই আবার সেই সব বালকেরা ও গোবৎসেরা রয়েছে। ব্রহ্মা চিন্তা করছিলেন ব্যাপারটা কি হল? যাদের লুকিয়ে রাখলেন তারাই বা কে? এই যে সমস্ত গোপবালকেরা কৃষ্ণের সঙ্গে আছে এরাই বা কে? কেননা কৃষ্ণই সমস্ত গোপবালক ও গোবৎসদের রূপ ধারণ করে নিজেকে বিস্তার করেছিলেন। তাই কৃষ্ণ যখন বিষ্ণুরূপে প্রকাশিত হয়েছেন, প্রতিটি গোপবালক তাদের চতুর্ভুজ রূপ ধারণ করেছে। তাদের হাতে বলয়, কর্ণে কুন্ডল, চরণে নূপুর। এই রকম বক্ষে শ্রীবৎসচিহ্ন ধারণ করেছেন। সেই সমস্ত গোপবালকেরা। প্রভুপাদ বলছেন যে, সারূপ্য মুক্তি লাভ করলে এই রকম রূপ লাভ করা যায়। কৌস্তভমণি ও শ্রীবৎস চিহ্ন কেবল কৃষ্ণের বক্ষে থাকে। যখন বিদেশীরা ভারতে আসে তখন ওরা বলে  সব ভারতীয়গুলো দেখতে এক রকম। আবার ভারতীয়রা অনেক সময় বলে যে, সব বিদেশীরাই দেখতে এক রকম। বৈকুন্ঠে গেলে দেখা যাবে যে, দেখতে সবাই এক রকম। সবারই চতুর্ভুজ, মস্তকে মুকুট আছে, চরণে নূপুর আছে। যেন বিষ্ণুতে ভর্তি শহর। তখন কি করে চিনে নেবেন যে, কে প্রকৃত বিষ্ণু? তখন খুঁজতে হবে হবে, শ্রীবৎস আর কৌস্তভ মণি কার বক্ষে আছে। আর তা না হলে, প্রত্যেকেই দেখতে এক রকম। অবশ্য পরিচয় হলে পরে বিশেষ বিশেষ সম্পর্ক হয় তখন বুঝা যায়, কিন্তু সাধারণভাবে ওরা সবাই এক রকম। ব্রহ্মা আবার বিভ্রান্ত। বিপদে পড়েছেন। বালকগুলি কে? বিষ্ণুর রূপ ধারণ করছে শত শত বালক, এরাই বা কে? কি করে হল। ঐশ্বর্য মন্ডিত তাদের গা থেকে ব্রহ্মজ্যোতি বেরুচ্ছে। ব্রহ্মা তখন বিহ্বল হয়ে পড়েছেন কৃষ্ণের দ্বারা। ব্রহ্মা সাধারণত এ রকম আশা করেছিলেন না।

যখন কেউ সাযুজ্য মুক্তি লাভ করে, এক রকমের মুক্তি, যদিও ভক্তরা এই রকম মুক্তি আকাক্সক্ষা করেন না। সেখানে কোন সেবা নেই। পাঁচ প্রকারের মুক্তি আছে। সময় সময় ভক্তরা এই ধরনের মুক্তি গ্রহণ করে, যদি সেখানে ভগবৎ সেবায় যুক্ত থাকে। সাযুজ্য মানে হচ্ছে ভগবানের অঙ্গজ্যোতিতে মিশে যাওয়া। সারূপ্য মানে হচ্ছে ভগবানের যেমন রূপ, সেই রকম রূপ আপনি প্রাপ্ত হবেন। সালোক্য মানে হচ্ছে এরকই লোকে বাস করা। ভগবান যেখানে বাস করেন আপনিও সেখানে থাকবেন। সামীপ্য মানে ভগবানের কাছাকাছি থাকবেন। সার্ষ্টি মানে হচ্ছে ভগবানের মতোই ঐশ্বর্যশালী থাকবেন। এগুলো হচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের মুক্তি। যারা বৈকুন্ঠে বাস করেন, তারা সাধারণত চতুর্বিধ মুক্তি লাভ করে থাকেন। সেটা স্বাভাবিক। সারূপ্য মানে হচ্ছে একই রকম রূপ হতে হবে তাদের। বিষ্ণুর মতো দেখতে হবে। চিন্ময় জগতের দিব্য ঐশ্বর্য দ্বারা মন্ডিত তাদের নিজস্ব বিমান আছে। তারা এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় পুষ্প বিমানে করে অনায়াসে যেতে পারেন। জেট-ফেট লাগে না। আমাদের এখানে কারিগরি বিদ্যায় এত উন্নত হয়নি। চিন্ময় জগতে এগুলো হচ্ছে চিন্ময় ঐশ্বর্য। লোকের অবশ্য ইচ্ছে করে, যেরকম চিন্ময় জগতে সুবিধা আছে সেই সুবিধাগুলি যদি এখানে করা যেত বিভিন্ন যন্ত্রপাতির মাধ্যমে।

ব্রহ্মা নিজেকে একটু বড় বলে মনে করতেন। এই গোপবালক ও গোবৎসগুলি যে অসাধারণ হবে তা তিনি ভাবতে পারেন নি। কৃষ্ণের থেকে তাঁর কিছু শিক্ষা হল। কৃষ্ণ কৃপালু। সমস্ত গোপবালকেরা চুরি হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণ রাগ করেননি। কৃষ্ণ রাগ করতে পারবেন। বদলা নিতে পারতেন। তা না করে ব্রহ্মাকে আশীর্বাদ করেছেন। তাঁকে শিক্ষা দিচ্ছেন। কেউ যদি এসে আপনার ছেলে বা মেয়েকে চুরি করে নিয়ে যায়, তাহলে আপনি সেই লোকটিকে দেখে কি রকম করতেন। প্রচন্ড বিক্ষুব্ধ ও ক্রোধান্বিত হতেন। সে রকম হতে পারত কৃষ্ণের। কিন্তু কৃষ্ণ সব ব্যাপারেই সংযত। এই সমস্ত ঘটনা পরে ব্রহ্মা তখন অত্যন্ত বিনীত হয়ে পড়েছেন। তিনি কৃষ্ণের চরণে চারটি মস্তক দিয়ে প্রণাম জানিয়েছেন।

তারপর ব্রহ্মা নবদ্বীপে এসেছিলেন। নবদ্বীপ হচ্ছে একটা মস্ত বড় পদ্মের মতো। মাঝখানে যেন পদ্মের একটা কর্ণিকা আছে। ওখানে বসে তিনি ধ্যান করতে শুরু করলেন। তিনি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নাম জপ করতে লাগলেন। গৌরাঙ্গ, গৌরাঙ্গ, গৌরাঙ্গ। তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ব্রহ্মার কাছে এসেছেন। ব্রহ্মা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছেন। লাফিয়ে উঠেছেন। উঠে প্রার্থনা করতে শুরু করবেন। কিন্তু তার বাক্ রুদ্ধ হয়ে গেছে। তিনি বিহ্বলচিত্তে তখন গৌরাঙ্গকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানিয়েছেন। তারপর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁকে বললেন, তুমি কেন ডেকেছ? কি চাও, কী আশীর্বাদ চাইছ?

ভগবান যখন ভক্তের কাছে আসেন তাঁর নিয়ম হচ্ছে যে তিনি আশীর্বাদ করবেন। যখন এক সময় লোকেরা পরীক্ষিৎ মহারাজের বাবার প্রশংসা করছিল, তখন তাদেরকে পরীক্ষিৎ মহারাজ সোনার উপহার দিয়েছিলেন। সেই রকম ভগবান যখন আসেন তখন জিজ্ঞাসা করবেনে যে কি চাও, আশীর্বাদ গ্রহণ কর। ভক্তকে কিছু দেওয়া হয়। ব্রহ্মজ্যোতিতে বিলীন হয়ে যেতে পার। ভগবানের সঙ্গে এক হয়ে যেতে পার। ভগবানের দিব্য জ্যোতিতে বিলীন হয়ে যেতে পার। ব্রহ্মজ্যোতিতে বিলীন হয়ে যেতে ভক্তরা চান না। হে কৃষ্ণ আমি তা চাই না, আমি তোমার সেবা করতে চাই। কৃষ্ণ আপাকে কিছু দিতে চান আর আপনি চাইছেন না। হয়তো ভগবদ্ধামে যাওয়ার জন্য টিকিট দিয়ে যেতে পারেন। সময় সময় কৃষ্ণ পরীক্ষা করতে চান। কি চান আপনি? কলাবেচা শ্রীধরকে তিনি অনেক কিছু দিতে চেয়েছিলেন। রাজা হবে? অলৌকিক শক্তি, আরও কিছু দিতে চেয়েছিলেন। ভগবান হয়তো বলতে পারেন তুমি কি অলৌকিক শক্তি পেতে চাও? তাহলে ভালই হয়। তাহলে আর আমাকে আকাশে ভ্রমণ করার জন্য টিকিটি লাগবে না। কিন্তু সাবধান হতে হবে। ব্রহ্মাকে ভগবান জিজ্ঞাসা করলেন যে, কী আশীর্বাদ চাইছ? ব্রহ্মা জানতেন না যে কি চাইবেন? তিনি বললেন যে, আমার অর্ধেক জীবনতো অতিবাহিত হয়ে গেছে। আমার জীবনের দ্বিতীয় ভাগটা আছে। ৫০ বছর পার হয়ে গেছে। আমার জীবনের। মানুষ চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বছর পার হলে চিন্তা করে যে কি করবে? কি করলাম জীবনে? ব্রহ্মা বলছেন, ৫০ বছর হয়ে গেল, তবুও আপনার কাছে অপরাধ করছি। গরু বাছুর চুরি করলাম, গোপবালক চুরি করলাম, কত অপরাধ করলাম। আমি আশীর্বাদ চাই যাতে করে আমি আপনার প্রতি শুদ্ধভক্তি লাভ করতে পারি, যাতে করে আমি আর কখনও অপরাধ না করি। বিনীত হই। যাতে সর্বদা আপনার সঙ্গ লাভ করতে পারি। যখন আপনি কলিযুগে পৃথিবীতে আসবেন তখন আপনার সঙ্গ পেতে চাই। তখন মহাপ্রভু বললেন ‘তথাস্তু’। তাই হোক। যা তুমি চাইছ তাই হবে। বিনীত হওয়ার জন্য তুমি জন্ম গ্রহণ করবে মুসলমান পরিবারে। কিন্তু তুমি প্রতিদিন তিনলক্ষ হরিনাম করবে। তখন তোমার নাম হবে নামাচার্য। হরিনামের গুরু। তুমি আমার পার্ষদ হবে। তুমি আমার আগে আসবে। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। তোমাকে লোকে বলবে হরিদাস। তুমি সত্যলোকে ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরী হও। আমি পাঁচহাজার বছর পরে পুনরায় আসছি।

ব্র্রহ্মার হিসাবে বেশি দিন নয়। ইতিমধ্যেই পাঁচ হাজার বছর পার হয়ে গিয়েছিল। ব্রহ্মার বেশি সময় ছিল না। সবাইকে যে বলে আসবেন তারও সময় নেই। যদিও হয়তো ব্রহ্মলোকের হিসাবে সামান্য কয়েক বছর। আমাদের হিসাবে যে ৭০/৮০ বছর সময় ব্রহ্মার হিসাবে তা কয়েক মুহূর্ত মাত্র। হরিদাস ঠাকুর পৃথিবীতে কত বছর ছিলেন? ৮০ বছর মাত্র। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ছিলেন ৪৮ বছর এই পৃথিবীতে। আর হরিদাস ঠাকুর ছিলেন তখন মধ্য বয়সী। হরিদাস ঠাকুর ভাবলেন যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যখন চলে যাবেন তখন তিনি যেন এই পৃথিবীতে না থাকেন। তাই তিনি শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর কাছে প্রার্থনা করলেন। মহাপ্রভুর অপ্রকটের কিছুদিন আগে তিনি অপ্রকট হন।

এই ব্রহ্মবিমোহন লীলার সঙ্গে চৈতন্যলীলার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। কৃষ্ণলীলা এবং চৈতন্যলীলার সঙ্গেও যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। যেমন সুরভী গাভী এসেছিলেন, ইন্দ্র এসেছিলেন, বৃন্দাবনে যখন ইন্দ্র প্রচুর বর্ষন করেছিলেন, সারা বৃন্দাবনকে প্লাবিত করতে চেয়েছিলেন তখন কৃষ্ণ গিরিগোবর্ধণ উত্তোলন করেছিলেন। তারপর ইন্দ্র আত্মসমর্পণ করলেন তারপরে স্বর্গের সুরভী গাভী সুরভীকুঞ্জে এসেছিলেন। সুরভীকুঞ্জ হচ্ছে সরস্বতী (জলঙ্গী) নদীর ওপারে। ওখানে গিয়ে তাকে দর্শণ করতে পারেন, যদি আপনার দিব্য দৃষ্টি থাকে। তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু সবার কাছে প্রকাশ হন না। খুব ভাগ্যবান না হলে দর্শন করা যায় না। সুরভী গাভী সাধারণত আমাদের এই মর্ত্য জীবের দৃষ্টিগোচর হন না। মার্কন্ডেয় ঋষিও এখানে এসেছিলেন। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর তাঁদের উপস্থিতি সম্বন্ধে খুব সচেতন ছিলেন। এইভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। বৃন্দাবনের যে দ্বাদশ বন সেগুলিও মায়াপুরে আছে। নবদ্বীপ মন্ডল পরিক্রমায় গেলে আমরা দেখি বেলপুকুর হচ্ছে বেলবন। দীনবন্ধু প্রভু আমাদের পরিক্রমায় নিয়ে গিয়েছিলেন দ্বাদশ কানন ভ্রমণ করতে। প্রায় গুলোই ভ্রমন করেছি। অনেকগুলি করা হয়নি। ঐ বনগুলি এইখানেও রয়েছে। বৃন্দাবনের সেই রাধাকুন্ড, ঋতুদ্বীপের রাদুপুরে রাধাকুন্ড, শ্যামকুন্ড আছে। গোবর্ধন কোলদ্বীপে থাকার কথা। বৃন্দাবন, অযোধ্যা অন্যান্য তীর্থস্থানও মায়াপুরে বর্তমান। বৈকুন্ঠ আছে। সমস্ত নারায়ণেরা বৈকুন্ঠে থাকেন। এই বৈকুন্ঠ আবার বৃন্দাবনে আছে। নবদ্বীপ ধামে এই একটি স্থান আছে বৈকুন্ঠপুর নামে। আমাদের লুপ্ত তীর্থের মধ্যে এটা একটি। গোদ্রুমদ্বীপে কোথায় কি আছে আমরা যথাযথভাবে জানি না। ভালভাবে খোঁজ নিতে হবে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বৃন্দাবনে গিয়েছিলেন, দেখেছিলেন একটি ডোবা। তখন শ্রী চেতন্য মহাপ্রভু বললেন এটা হচ্ছে রাধাকুন্ড। তারপর এটা খনন করা হল। ষড়গোস্বামীরা খনন করেছিলেন। এই রকম মহাপ্রভু, রাধামাধব যদি আর আরও প্রকাশ করেন, নবদ্বীপের বিভিন্ন স্থানে কোন্ জাযগায় কি কি আছে। নবদ্বীপ ধাম, বৃন্দাবন ধাম, সবই এখানে আছে। শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর বলেছেন–

শ্রীগৌড়মন্ডল-ভূমি যেবা জানে চিন্তামণি,

তা’র হয় ব্রজভূমে বাস।।

আমরা ব্রজভূমিতে বাস করতে পারি যদি আমরা বুঝতে পারি যে, গৌড়মন্ডল হচ্ছে চিন্তমণি ধাম, দিব্য ধাম।

ব্রহ্মা ব্রজে এসে কৃষ্ণকে দেখলেন আর সেই কৃষ্ণের গোপবালক ও গোবৎস সব হরণ করলেন। তারপরে উনি ফিরে এসে ভাবলেন যে, মস্ত বড় ভুল হয়েছে। যে সব গোপবালক নিয়ে গিয়েছিলাম আবার এরাই তো এখানে। তারপর তাদের নারায়নরূপ দেখে ব্রহ্মা তাজ্জব হয়ে গেলেন। ব্রহ্মাজী নিজেকে বিস্তার করে এরকমভাবে নারায়ণ দেখতে পারবেন না। কৃষ্ণের অনন্ত শক্তি। অনন্তলীলাময় কৃষ্ণ। দামোদর অষ্টকে বলা হয়, নমো অনন্তলীলায়। তাঁর অনন্ত লীলা, অসীম ক্ষমতা, তা সত্ত্বেও তাঁর মায়ের স্নেহে তিনি রুজ্জুবদ্ধ হন। সেই হচ্ছে দামোদরলীল।

কিছু কিছু বিজ্ঞানীরা খোঁজার চেষ্টা করছেন, কখন মহাভারত লেখা হয়েছিল। একজন বিজ্ঞানী বলেছেন যে, তিন হাজার চৌষট্টি বছর পূর্বে এবং ভারতীয় একজন বিজ্ঞানী বলছেন যে, এক হাজার ছয়শত বছর আগে। বিভিন্নভাবে তারা বিচার করতে চেষ্টা করছেন। খবরের কাগজে প্রায় সময়ই দেখা যায় এরকম কত উল্টা পাল্টা। প্রকৃত সেই মহাভারতের ঘটনাটা কোন সময়ে হয়েছিল এই ব্যাপারে অনেকেই মনগড়া চিন্তা করে। ওরা চেষ্টা করছে খুঁজে পেতে জল্পনা-কল্পনা করে। শেষ পর্যন্ত পাঁচহাজার বছর আগের ঘটনা কোথা থেকে কি পাব। প্রভুপাদ যখন শ্রীমদ্ভাগবত প্রণয়ন করেছেন তখন বলেছেন যে এটা ইতিহাস। এগুলি ঘটেছে। শ্রীল শুকদেব গোস্বামী, মহর্ষি ব্যাসদেব শুধু শুধু কিছু গল্প বানান নি। এটা ঐতিহাসিক ঘটনা, কৃষ্ণ ছিলেন, কৃষ্ণ বসবাস করেছেন। কৃষ্ণ অদ্ভুত কিছু করতে পারেন।

তাঁর পবিত্র ধামে আসতে পারা খুব সৌভাগ্যের বিষয়। গুপ্ত বৃন্দাবনে আসতে পেরেছি। আমরা খুব ভাগ্যবান। এখানে ব্রহ্মা আশীর্বাদ পেয়েছেন, ব্রহ্মা জানতেন যে, কৃষ্ণের কৃপাময় রূপ হচ্ছেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর রূপ। নিজেকে সংশোধন করার জন্য ভগবানের শুদ্ধভক্ত যাতে হওয়া যায় ব্রহ্মাজী সুযোগ নিয়ে ছিলেন এই নবদ্বীপ ধামে। ব্রহ্মাজী যদি নিজেকে সংশোধন করতে আসেন, তাহলে আমাদের আর কি কথা। আমরা কত পতিত। আমি কত পতিত। আপনারা অনেক উন্নত আছেন। মহাপ্রভুর কৃপা আমার দরকার। তাই আমি নবদ্বীপ ধামে আসি। কারণ এখানে কৃপা প্রবাহিত হচ্ছে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু পরম করুন।

পরম করুন, পঁহু দুইজন,

নিতাই গৌরচন্দ্র।

সব অবতার- সার- শিরোমণি,

কেবল আনন্দ-কন্দ।

ভজ ভজ ভাই, চৈতন্য নিতাই,

সুদৃঢ় বিশ্বাস করি।

বিষয় ছাড়িয়া, সে রসে মজিয়া

মুখে বল হরি হরি।।

তিনি হচ্ছেন সমস্ত অবতারদের শিরোমণি তিনি বিনামূল্যে কৃপা বিতরণ করছেন। আপনি যোগ্য কি যোগ্য নন, তাতে বিচার করছেন না। কমপক্ষে আমারতো কোন যোগ্যতাই নেই। আমিতো একটা হতাশ ব্যক্তি। আপনাদের অনেকের যোগ্যতা আছে, আমার কোন যোগ্যতাই নেই। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু, শ্রীমন্ নিত্যানন্দ প্রভু, তাঁরা কৃপা করেছেন। নির্বিচারে, অর্থাৎ এই ব্যক্তি যোগ্য কি অযোগ্য এসব বিচার না করে তাঁরা কৃপা বিতরণ করেছেন। কোন না কোন ভাবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপা লাভ করার জন্য সেই কামনা বর্ধন করতে পারি তা হলে তিনি হয়তো তাঁর কৃপা প্রদান করবেন। সময় সময় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপার জন্য কান্না করতে হবে। ব্রহ্মা কান্না করছিলেন। সময় সময় অনুভূতি আসে। ব্রহ্মার শিক্ষা যে, আমরা কিছু অনুভূতি লাভ করি। তাই সময় সময় আমরা বিভিন্ন অসুবিধায় পড়ি পারমার্থিক জীবনে। বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। প্রভুপাদ বলেছেন যে, এই ধরনের যে সমস্যায় পড়া, পারমার্থিক অগ্রগতির জন্য এগুলো আমাদের সহায়ক হতে পারে। সেগুলো কাজে লাগাতে হবে। সেই গুলিকে ব্যবহার করতে হবে আরও বেশী পারমার্থিক জীবন দৃঢ় করার জন্য। যাতে করে নিতাই-গৌরের কৃপা লাভ করতে পারি, পঞ্চতত্ত্বের কৃপা লাভ করতে পারি। যদি গুরুগৌরাঙ্গের কৃপা লাভ করতে পারি, আর তা হলে বুঝতে পারা যাবে যে, এই সব সমস্যাগুলো লুক্কায়িত আশীর্বাদ। কোন না কোন ভাবে আমরা ধামে এসেছি। আমাদের খুব সাবধান থাকতে হবে। কৃপা লাভ করার চেষ্টা করতে হবে। গভীরভাবে কামনা করতে হবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপা পাওয়ার জন্য। ব্রহ্মা অনেক অপরাধ করেছিলেন কিন্তু কৃষ্ণ কৃপা করেছিলেন কৃষ্ণ বড় সহিষ্ণু। আর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কি কথা। প্রভুপাদ বলেছেন যে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কৃষ্ণ অপেক্ষা হাজার গুণ কৃপালু। তিনি পাপীতাপীকে উদ্ধার করেছেন।

পাপী তাপী যত ছিল হরিনামে উদ্ধারিল।

তার সাক্ষী জগাই আর মাধাই রে।।

ব্রহ্মা বালকগুলোকে নিয়ে মারামারি বা ঝামেলা করেননি। ঘুমিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু জগাই মাধাই বদমাশ ছিল। নিত্যানন্দ প্রভুকে মেরেছে। তবুও নিত্যঅনন্দ প্রভু মহাপ্রভুর কাছে প্রার্থনা করলেন, এদের কৃপা করুন। নিত্যানন্দ প্রভু কত কৃপালু। জগাই-মাধাই সেটা বুঝতে পেরেছিল। জগাই-মাধাইয়ের সমাধি আছে কাটোয়ায়। কাটোয়া গেলে দেখা যায় যেখানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন সেখান থেকে নিকটে রয়েছে যাজিগ্রাম। শ্রীনিবাস আচার্যের স্থান। তিনি ওখানে ছিলেন। অনেক লীলা হয়েছে। নরোত্তাম দাস ঠাকুর রামচন্দ্র কবিরাজকে নিয়ে এখান থেকে দশকিলোমিটার দূরে শ্রীখন্ডে বাস করতেন। নরহরি সরকার ঠাকুর, মুকুন্দ দাস, চিরঞ্জীব, পুরন্দর ঠাকুর আর অনেকে বাস করতেন। কাটোয়াতেই রয়েছে জগাই-মাধাইর সমাািধ। নবদ্বীপে কিছু শত্রুতা হয়েছিল বোধ হয়, তাই তাঁরা কাটোয়া গিয়েছিলেন। ওখানে মাধাই ঘাট করা হয়েছে। এত প্রেমানন্দে জগাই-মাধাই হরিনাম জপ করতেন যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা নাচতে শুরু করতেন। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত। স্বতঃস্ফূর্ত প্রেমে তারা মগ্ন ছিলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপায়। প্রতিদিন গঙ্গায় যেতেন স্নান করতে। পরমানন্দে নৃত্য করতেন। যদিও তাঁরা ছিলেন সবচাইতে বড় দস্যু। সারা নবদ্বীপ ধামে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এইভাবে কৃপা বিতরণ করেছেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন