যেখানে শুদ্ধ ভক্তি, সেখানে হয় না অগতি

 


শ্রীমদ্ভাগবতে কপিল মুনি দেবহূতিদেবীর কাছে বর্ণনা করছেন ভক্তিসেবা বিষয়ে। ‘ভক্তি’ কে বিশ্লেষণ করে তিনি বলেছেন যে, দু’প্রকার ভক্তি আছে- শুদ্ধ ভক্তি ও মিশ্র ভক্তি। সাধারণ মানুষ এটা বুঝতে পারে না। দেখা যায় লোকে এর কাছে তার কাছে প্রার্থনা করছে, মনে করছে সেটাই ভক্তি। কিন্তু কি ভক্তি?– শুদ্ধ, না, কর্মমিশ্রিত? এখানে কপিল মুনি তাঁর মায়ের কাছে ব্যাখ্যা করছেন আমরা কি করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করতে পারি। শুদ্ধ ভক্তি থাকলে তবেই ভগবানকে সহজে লাভ করা যায়। কিন্তু ভক্তি যদি মিশ্রিত থাকে, তা হলে বিভিন্ন ফল পাবে, ভগবানকে পেতে দেরি হবে।

তারপর, কপিল মুনি তমোগুণ মিশ্রিত ভক্ত, রজোগুণ মিশ্রিত ভক্তি বিশ্লেষণ করে এখন সত্ত্বগুণ মিশ্রিত ভক্তি কথা বলছেন। ‘আমি পাপ করলাম’ ‘আমি কষ্ট পাচ্ছি’, ‘আমি ভগবানকে পূজো করব’, ‘আমি সেই কষ্ট থেকে মুক্ত হব’,– এই ধরনের পূজো হচ্ছে সত্ত্বগুণে যারা আছে তাদের। রজোগুণে যে ভক্তি আছে, তাতে লোকে কোনও ফল চায়, স্বর্গে যেতে চায়, কিন্তু ভগবানের আশীর্বাদ চায় না; শত্রুকে নষ্ট করতে চায় কিংবা অভিমান করে দেখায় যে, আমি ভক্তি করতে পারি– এসবে ভগবানকে সন্তুষ্ট করার কোনও উদ্দেশ্য নেই। শুদ্ধ ভক্তি মানে হচ্ছে ভগবানকে খুশি করা, শুদ্ধ ভক্তি হচ্ছে প্রেমের বস্তু।

দোকানে কাজ করছে কোনও কর্মচারী; মালিক দেখছে খুব কাজ করছে। মালিক যদি মাইনে বাদ দেয়, সে কি আর কাজ করবে? মালিককে সে খুশি করতে চায় ভাল মাইনে পাবে বলে, পদের উন্নতি হবে এই আশায়।

শুদ্ধ ভক্তি হচ্ছে, ভগবান আমাকে অপমান করুন, আমাকে দুর্বিপাকের মধ্যে রাখুন- আমার কিছু যায় আসে না, আমি ভগবানকে সেবা করেই যাব।

শ্রীচৈতন্যদেব শিক্ষাষ্টকের অষ্টম শ্লোকে তাই বলেছেন। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর গান করেছেন–

“মানস দেহ গেহ যো কিছু মোর।

অর্পিলুঁ তুয়া পদে, নন্দকিশোর।।

সম্পদে বিপদে জীবনে মরণে

দায় মম গেলা তুয়া ও পদ বরণে।”

অর্থাৎ “তুমি আমাকে সম্পদে রাখ, কি বিপদে রাখ আমার মন প্রাণ সব তোমার পদে অর্পণ করলাম। তোমার সেবা ছাড়া আর আমার কোনও উদ্দেশ্য নেই।” এই হচ্ছে শুদ্ধ ভক্তি।

কেউ যদি প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গাড়ির সামনে লাল বাতি রাখতে পারে, সে খুব গর্বিত হয়ে যায়। একজন প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘যখন ঐ লাল বাতি জ্বলত, তখন সব গাড়ি পাশ করে রাস্তা করে দিত। খুব ভাল লেগেছিল।’ কিন্তু কিছুদিনের মন্ত্রী হয়, তারপর লোকে খবরের কাগজে বদনাম দেয় আর অন্য কাউকে নির্বাচন করে। আবার ব্রহ্মা হলে অনেক কাল সম্মানের পদে থাকা যায়। অভক্ত তা চাইতে পারে। তার চেয়ে ভক্তের পেটের যদি একটা কৃমি হতে পারতাম, তা হলে সেটাই ভাল। ভক্তের গৃহে আমি থাকতে চাইছি, কৃমি হলে আমি মহাপ্রসাদ উচ্ছিষ্ট পাব। এই কথা আমরা চিন্তা করি না। এই হচ্ছে শুদ্ধ ভক্তি। আমি যেভাবে দীনহীন হয়ে থেকেও ভগবানকে সন্তুষ্ট করব।

ভগবানকে সন্তুষ্ট করলে লাভ কি?— শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন এবং দুর্যোধনকে বলেছিলেন তোমরা সিদ্ধান্ত কর, কে আমার সৈন্যকে চাও, আর কে আমাকে চাও। আমি যাকে প্রথম দেখব বিশ্রাম থেকে উঠে তাকে আগে বলার সুযোগ দেব।

তখন দুর্যোধন চিন্তা করছে, এখন একলা কৃষ্ণ তো নিজে যুদ্ধ করবে না, তাকে নিলে আর লাভ কি? আমি চাই কৃষ্ণের সৈন্য, তা হলে আমি তার শক্তিশালী সৈন্য দিয়ে ভাল যুদ্ধ করতে পারব।

অর্জুন চিন্তা করছে, শ্রীকৃষ্ণ না এলে তার সৈন্য আর কি করবে? শ্রীকৃষ্ণ থাকলে সবই আছে, উনি থাকলে সবই মঙ্গল হয়ে যাবে। ওনার সৈন্যদের আমার দরকার নেই, শ্রীকৃষ্ণকে আমাদের দরকার।

দুর্যোধন মনে করছে, আমি কৃষ্ণের মাথার কাছে বসব, উনি যখন বিশ্রাম থেকে উঠবেন তখন আমাকে আগে দেখবেন। কিন্তু অর্জুন ভেবেছে, আমি শ্রীকৃষ্ণের চরণের কছে বসব, আমি শ্রীকৃষ্ণের চরণের ধুলায় থাকতে চাইছি। শ্রীকৃষ্ণ যখন বিশ্রাম থেকে উঠলেন, মাথা বেঁকিয়ে দুর্যোধনের দিকে ফিরে বললেন, ও, আমি অর্জুনকে দেখছিলাম, বলো, তোমার কি চাই।

অর্জুন যখন বলল, কৃষ্ণ, আমি তোমাকে চাই তা হলেই আমার সব সঙ্কট মিটে যাবে, তখন দুর্যোধন ভাবছে অর্জুনের কি মতিভ্রম হল!

জড় জগতের মানুষ বোঝা না যে, শ্রীকৃষ্ণকে যদি পাই সবই তো পাওয়া হয়ে গেল। শ্রীকৃষ্ণকে বাদ দিয়ে তার পরিবর্তে কি চাইছে?— পয়সা দাও, এটা দাও, ওটা দাও। কিন্তু সমস্যা তার থেকেই যাবে। যারা শ্রীকৃষ্ণকে পাচ্ছে, তাদের হৃদয় নির্মল হয়ে প্রেম লাভ করে– তখন তাদের জীবন এমনি আনন্দময়। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, যেটা তোমার আছে আমি রক্ষা করব, আর যেটা তোমার লাগবে আমি দিয়ে দেব। কিন্তু সেটা কাকে? — যারা শুদ্ধ ভক্ত, শ্রীকৃষ্ণের উপর নির্ভর করছে। যারা পূজা করে– ওটা দাও, ওটা দিলে খালাস হয়ে যাবে, আমি এতটুকু পূজা করলাম, এতটুকু চাইলাম– শ্রীকৃষ্ণ দেবেন, কিন্তু এখন দিতে পারেন, পরে দিতে পারেন, নাও দিতে পারেন।

আবার অনেক সময়ে দেখা গেছে শ্রীকৃষ্ণের পূজা করলে, কতটা দেবেন শ্রীকৃষ্ণ বুঝে দেবেন, শ্রীকৃষ্ণ তো ভক্তকে নষ্ট হতে দিতে চান না– যেমন যদি মাকে বল, আমাকে চাকু দাও, আমি খেলা করব, মা চাকু কি দেবে খেলা করতে? কখনো দেবে না।

যেমন, ধ্রুব মহারাজ চেয়েছেন রাজা হতে। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে রাজা করে দিলেন, কিন্তু যখন সব পেলেন ধ্রুব মহারাজ দুঃখিত হলেন, তিনি ভাবলেন, শ্রীকৃষ্ণকেই কেন চাইলাম না?

এইভাবে প্রথমে ধ্রুব মহারাজের হয়তো একটা উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু পরে শ্রীকৃষ্ণের সাথে মিলন হওয়ায় সেই চাওয়াটা ভুল চাওয়া মনে হল।

যাদের কর্মমিশ্রিত ভক্তি তা শুদ্ধ হয়ে যায়। শুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা আছে, শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আসক্তি ক্রমশ বাড়ে। যারা দীক্ষিত হতে চাইছে, এই জীবনে শ্রীকৃষ্ণের কাছে ফিরে যেতে চাইছে তারা চেষ্টা করতে পারে মিশ্র ভক্তি না করে শুদ্ধ ভক্তি করতে। এটা অবশ্যই আমাদের প্রয়োজন আছে।

অনেক সময়ে মন অনেক আবোল তাবোল চিন্তা করে ফেলে, তখন যুক্তি দিয়ে মনকে শাসাতে হবে– আমি চাই কৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করতে– এ ছাড়া অন্য চিন্তা করো না। তা হলেই শুদ্ধ ভক্ত যে প্রেম আনন্দ লাভ করছে তুমিও তা লাভ করবে।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই প্রেম সহজে দিচ্ছেন সবাইকে। কিন্তু শুদ্ধ ভক্তি থাকলে তবেই সে প্রেম আনন্দকে রাখতে পারবে। তার ভক্তির মধ্যে যদি অন্য কামনা থাকে, তখন ঐ প্রেম আনন্দ আস্বাদন করা স্থায়ী থাকে না।

আমরা কৃষ্ণের কাছে গেলাম- ক্ষণিকের জিনিস নিলে কি হবে? স্টক মার্কেটে বাজার মন্দা করে দিল, সে অনেক পুঁজি রেখেছে স্টক মার্কেটে তার আর কিছুই নেই। এই জন্য আমাদের জীবনে মরনে বিপদে সম্পদে একমাত্র ভরসা হচ্ছেন- শ্রীকৃষ্ণ! এছাড়া তো আমাদের আশ্রয় নেই।

গৃহীরা ভাবে আমি গৃহী, আমি ভগবানের কাছে টাকা চাইব না তোর কার কাছে চাইব? এটারও শ্রীল প্রভুপাদ সুন্দর ব্যাখ্যা করেছেন যে, ছোট শিশুকে কি মা বাবার কাছে চাইতে হয়– আমায় খেতে দাও আজকে? বাচ্চা তো খেয়াল করে না কখন খেতে হয়, ওরা খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত। মা-বাবা তাদের ডেকে আনে।

এইভাবে আমরা ভগবানকে সেবা করলে চাইবার কি দরকার? আমরা নিজেদের ভাল-মন্দ ভবিষ্যৎ কতটুকু আর বুঝতে পারি? কেউ মনে করছে– আমার ছেলে হলে খুব খুশি হব, ভগবানের কাছে সন্তানের বর চাইল, বর পেল, কিন্তু ছেলে হল বদমাইশ চোর ডাকাত। তখন ভাবল, আরে বাবা, ছেলেহীন থাকা অনেক ভাল ছিল।

মালেশিয়াতে এক পরিবারের ছেলে চাইছে– আমি ভক্ত হব; বাবা-মা বলছেন, আর দু’বছর শিক্ষা দেব, তারপর বিয়ে। তখন তোমাদের সাথে থাকতে পারবে। কিন্তু এখন দেখছে ছেলে বাইরে গিয়ে এমন দুঃসঙ্গ শিখেছে, নেশা করছে, ব্যবসা করছে, বিভিন্ন রকম কালোবাজারি করছে। এখন ওরা জোড়হাত করছে– ‘হে ভগবান, আমাদের ছেলেকে গ্রহণ কর।’ এখন ছেলে আর আসতে চায় নাকি?

এই জন্য ভক্তি যখন এই তিনটি গুণের সাথে মিশে থাকে, তখন সহজে অগতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। শুদ্ধভক্তি যেখানে, সেখানে অগতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তখন ভগবানের দিকে মনটা চলে যায়, ভবিষ্যতে ভগবানের কাছেই ফিরে যায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন