ভগবান শ্রীনৃসিংহদেবের আবির্ভাব

 



প্রহ্লাদ মহারাজের একমাত্র দোষ ছিল তিনি পরমেশ্বর ভগবান বিষ্ণুকে স্মরণ করতো। হিরণ্যকশিপু ত্রিজগতের অধীশ্বর হয়েছিল। দেবরাজ ইন্দ্রকে জয় করেছিল। এটা একটা ভালো উদাহরণ যে, আমরা মনে করি ইন্দ্রিয় তৃপ্তি করে সুখী হবো। এই ইন্দ্রিয়তৃপ্তির বাসনা হিরণ্যকশিপুর ছিল অতুলনীয়। সমগ্র জগৎ জয় করে নিলো, কিন্তু একটি জিনিসকে সে জয় করতে পারল না। সে তার ইন্দ্রিয়কে জয় করতে পারেনি। প্রহ্লাদ মহারাজ বলেছেন, যারা ইন্দ্রিয়কে জয় করতে পারেনি, তারা কখনও শান্তি পায় না। পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং মন দিয়ে আমাদের এই স্থুল শরীরটি গঠিত হয়েছে। ইন্দ্রিয়ের যারা সেবা করে থাকে তাদের বলা হয় গোদাস। যারা ভগবানের সেবায় নিজের ইন্দ্রিয়কে নিযুক্ত করে থাকেন, তাদের বলা হয় গোস্বামী। গোদাস মানে প্রবল মাত্রায় ইন্দ্রিয় তোষণ। গোস্বামী হতে গেলে আমাদের ইন্দ্রিয়কে ভগবানের সেবায় নিযুক্ত করতে হবে। ভগবানের সেবা হচ্ছে গোস্বামী হওয়ার একমাত্র উপায়। ভগবানের সেবায় আমাদের ইন্দ্রিয়কে ব্যবহার করে শান্তি লাভ করতে পারি। ইন্দ্রিয়ের দাস ছিল এই হিরণ্যকশিপু। যদিও তার অসীম ক্ষমতা ছিল তার ইন্দ্রিয়কে সেবা করতে। হিরণ্যকশিপু পরমেশ্বর ভগবান বিষ্ণুর গুণগান সহ্য করতে পারে নি। তাই তিনি প্রহ্লাদ মহারাজকে বললেন, “কি স্পর্ধা তোমার আমিই হচ্ছি এই জগতের সবচেয়ে শক্তিশালী, তুমি আমার পূজা না করে বিষ্ণুর সেবা কর। এবার তেমাকে শেষ করে দেবো! দেখি তোমার সেই পরমেশ্বর ভগবান তোমাকে বাঁচাতে আসে কিনা, আমি দেখতে চাই।” এরপর হিরণ্যকশিপু বলল “এই স্তম্ভটির মধ্যে তোমার ভগবান আছে কি?” প্রহ্লাদ মহারাজ বললেন, “আমার ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান, তিনি সমস্ত স্থানেই অবস্থান করেন।” তখন হিরণ্যকশিপু বললেন, “তুমি আমার পুত্র নও, তোমার আমি মস্তক ছেদন করব, দেখি আমার চেয়ে শক্তিশালী তোমার বিষ্ণু এসে তোমাকে রক্ষা করে কি না।” তারপর যেই হিরণ্যকশিপু তরবারি উত্তোলন করে প্রহ্লাদ মহারাজকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন ঠিক সেই সময় ভীষণ গর্জন করে সেই স্তম্ভ থেকে অর্ধেক নর ও অর্ধেক সিংহ রূপী ভগবান নৃসিংহদেব বেরিয়ে এলেন। হিরণ্যকশিপু দেখছেন এ অসুর না মানুষ, এতো অসুরও নয় আর মানুষও নয়। হিরণ্যকশিপু ব্রহ্মার কাছ থেকে বর পেয়েছে, কোন অসুর তাকে মারতে পারবে না, কোন মনুষ তাকে মারতে পারবে না। ভগবানের শক্তি অসীম, অপরিমিত যারা অসুর তারা চিন্তা করতে পারে না, অনুমান করতে পারে না, কল্পনা করতে পারে না ভগবানের শক্তি কতটা। তাই হিরণ্যকশিপু চিন্তা করলেন কোন অসুর আমাকে মারতে পারবে না, দেবতা মারতে পারবে না, কোন মানুষ মারতে পারবে না, তাহলে কে আমাকে মারতে পারে। কিন্তু ভগবান শ্রীহরি যে অর্ধেক মানুষ এবং অর্ধেক পশুর রূপ হবে সেটা হিরণ্যকশিপু চিন্তা করতে পারেনি।

পরমেশ্বর ভগবানের এত শক্তি আছে যেকোন জায়গায়, যেকোন অবস্থায় যেকোনভাবেই হোক তিনি তাঁর ভক্তকে রক্ষা করেন। সেইজন্য বিষ্ণুই হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান। তাই হরিণ্যকশিপুর সমস্ত সৈন্যগণ নরসিংহদেবের উপর আক্রমণ করতে উদ্যত হলে নৃসিংহদেবর প্রলয়াগ্নির দ্বারা তারা ভস্মীভূত হলো। তখন হিরণ্যকশিপু বললেন “এবার আমি বুঝেছি তুমি বিষ্ণু, আমাকে মারতে এসেছ। কিন্তু আমাকে কেউ মারতে পারবে কি? আমি অমর। আমার মতো যোদ্ধা কেউ নাই।” এইভাবে হিরণ্যকশিপু তখন নরসিংহদেবের উপর আক্রমণ শুরু করে। বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে তিনি নরসিংহদেবের প্রলয়াগ্নির মতো জ্যোতি দেখতে পেল। আর সেই জ্যোতির মধ্যেই হিরণ্যকশিপু অদৃশ্য হয়ে গেল। যেহেতু হিরণ্যকশিপু অসুর, তাই সে ঢাল তলোয়ার নিয়ে আবার নরসিংহদেবকে আক্রমণ করতে উদ্যত হল। কিন্তু কিছু করতে পারল না। নরসিংহদেব হিরণ্যকশিপুকে ধরে একটা পোকার মতো টেনে নিয়ে তাকে দরজার সামনে নিয়ে গেলেন। তারপর নরসিংহদেব হিরণ্যকশিপুকে তাঁর হাটুর উপর স্থাপন করে তাঁর তীক্ষ্ণ ধারালো নখ দিয়ে ছিঁড়ে ফেললেন। কারণ ব্রহ্মার কাছে সে সমস্ত বর লাভ করে নিয়েছে– ঘরের ভিতরে অথবা বাইরে তাকে মারতে পারবে না। কিন্তু ঘরের দরজা ঘরের ভিতর বা বাহির নয়। দিনে অথবা রাত্রে মারতে পারবে না– কিন্তু নরসিংহদেব তাকে গোধূলির সময় বধ করলেন যেটা দিনও নয় এবং রাত্রিও নয় কোন অস্ত্র দ্বারা তার মৃত্যু হবে না– তাই নরসিংহদেব তাঁর নখের দ্বারা তাকে বধ করলেন, নখ কোন অস্ত্র নয়। এভাবে হিরণ্যকশিপুকে প্রদত্ত ব্রহ্মার সমস্ত বর বজায় রেখে অদ্ভুত ভাবে তাকে হত্যা করলেন। নরসিংহদেবের সমস্ত কেশরাশি আকাশে ছড়িয়ে গেল। তার চোখ থেকে যে প্রলয়াগ্নির মতো জ্যোতি বের হতে লাগল তার দ্বারা সূর্য চন্দ্র ঢাকা পড়ে গেল। সমস্ত পাহাড় পর্বত উৎপাটিত হয়ে যাচ্ছে। স্বর্গের দেব দেবীগণ আকাশ থেকে পুষ্প বৃষ্টি করতে লাগল। ব্রহ্মা, ইন্দ্র, শিব, পিতৃলোক, সিদ্ধলোক, গন্ধর্ব, যক্ষ, তপলোক, সুনন্দ, কুমুদ সবাই ভগবান নরসিংহদেবের কাছে গিয়ে স্তব স্তুতি করতে লাগলেন। এ সম্বন্ধে শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন ভগবানের প্রতি সুদৃঢ় বিশ্বাস থাকার জন্য ভগবান প্রহ্লাদ মহারাজকে রক্ষা করলেন। তাই যারা কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করে ভগবানের চরণে আত্মসমর্পন করেন, ভগবান সবসময় তাদের সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করে থাকেন। নরসিংহদেব আমাদের হৃদয়ে বিরাজ করেন। তিনি আমাদের হৃদয়ে অবস্থান করে আমাদের সমস্ত অজ্ঞতারূপ অন্ধকার দূর করে দিব্য জ্ঞান দান করেন। আশা করি আপনারা সবাই ভগবান নরসিংহদেবের কাছে শুদ্ধ ভক্তির প্রার্থনা করবেন। জয় শ্রীনসিংহদেব ভগবান কি জয়!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন