মহাবদান্য শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু

 


পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ইচ্ছাক্রমে পর্যাপ্তভাবে অপ্রাকৃত লীলাবিলাস উপভোগ করার পর তিনি অন্তর্হিত হলেন। অবশ্য, অন্তর্ধানের পরে তিনি মনে মনে অনুমান করেন, “ এ পর্যন্ত আমি জগতের মানুষকে আমার প্রতি বিশুদ্ধ ভক্তি প্রদান করিনি। সেই ধরনের অনন্যভক্তি নিবেদন বিনা জগতের কোনই অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়। পৃথিবীর সর্বত্র শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে মানুষ আমার আরাধনা করে। কিন্তু এই বিধি-ভক্তি অনুশীলন করার মাধ্যমে ব্রজভূমির ভক্তদের প্রেমভাব প্রাপ্ত হওয়া যায় না। আমার ঐশ্বর্য সম্বন্ধে অবগত হওয়ার ফলে সমস্ত জগৎ আমাকে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে দর্শন করে। কিন্তু শ্রদ্ধার প্রভাবে শিথিল যে প্রেম, তা আমাকে আকৃষ্ট করে না। …. আমি স্বয়ং এই যুগের যুগধর্ম নাম-সংকীর্তন বা সম্মিলিতভাবে ভগবানের মহিমা কীর্তনের প্রবর্তণ করব। ভগবদ্ভক্তির চার প্রকার রস আস্বাদন করিয়ে আমি জগতকে প্রেমানন্দে উদ্বেলিত করে নৃত্য করাব। …. ভক্তের ভূমিকা অবলম্বন করে আমি ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা করার শিক্ষা প্রদান করব। আমার অংশ-প্রকাশেরাও প্রত্যেক যুগে অবতীর্ণ হয়ে যুগধর্ম প্রবর্তন করতে পারবে, কিন্তু আমি ছাড়া অন্য কেউ ব্রজের প্রেম দান করতে পারে না। … তাই আমি আমার আপন ভক্তদের সঙ্গে পৃথিবীতে অবতরণ করে বহুবিধ আনন্দময় লীলাবিলাস পরিবেশন করব।”এইভাবে চিন্তা করে, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কলিযুগের প্রথম ভাগে (সন্ধ্যায়) নদীয়ায় অবর্তীর্ণ হলেন।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রবর্তিত শ্রীভগবানের দিব্য নাম সংকীর্তনের ব্রতচারণ যে সর্বোত্তম কল্যাণকর্ম, এই সিদ্ধান্ত সামান্য কয়েকজন মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী- অনুসারীদের ভাববিলাসী বিচার-প্রসূত নয়। শুধুমাত্র বাস্তবানুগ বিচার মাধ্যমেই যে কেউ এই তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবেন। সেই কারণেই শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের লেখক, শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী এই পদ্ধতি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জনকল্যানকর কার্যকলাপের মাধ্যমে অবাধে প্রয়োগের জন্য আগ্রহী পাঠকদের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁরা যদি তা করতে পারেন, তা হলে তাঁরা উপলব্ধি করতে পারবেন যে, এই পদ্ধতি সব থেকে বিস্ময়করভাবে ফলপ্রসু হতে পারে।

দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা চলে, আমাদের আধুনিক সভ্যতার মধ্যেই মানব প্রগতি বলতে যা বোঝায়, তা বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের আপেক্ষিক মূল্যবোধ রীতি অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। যে সমস্ত মানুষ জাগতিক তথা ভৌত বিজ্ঞানের উপলব্ধিকেই জীবনের পরম আবশ্যক বলে দৃঢ়বিশ্বাস পোষণ করে থাকেন, তাঁদের কাছে নিউটন, ডারউইন, কিংবা ফ্রয়েডের মতো বিজ্ঞানীদের জটিল তত্ত্বগুলিকেই প্রগতিশীল বলে বিবেচিত হতে পারে। যাঁরা দৃঢ় মত পোষণ করে থাকেন যে, সামাজিক তথা রাষ্ট্রনৈতিক প্রগতিই জীবনের পরম আকাঙ্ক্ষিত ভাবধারা, তাঁদের কাছে লিঙ্কন কিংবা গান্ধীর কার্যকলাপই তার চেয়ে অনেক বেশি প্রগতিপন্থী বলে প্রতীয়মান হয়ে থাকে। আর যাঁরা মায়াবাদী কল্পচিন্তায় জটিলতাতেই বিশেষভাবে অভিভূত হয়ে থাকেন, তাঁদের কাছে প্লেটো, অ্যারিস্টস্টল, হিগেল, কিংবা কান্ট-এর চিন্তাসমৃদ্ধিকেই আরও বেশি প্রগতিশীল বলে মনে হতে পারে।

পরিণামে অবশ্য এই সমস্ত আপাত প্রগতির দৃষ্টান্তগুলি সবই ব্যর্থ হয়ে যায়, কারণ সেইগুলি শুধুমাত্র জড়জাগতিক জীবনের স্বপ্নময় অলীক পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথেই সম্পর্কিত ভাবধারা মাত্র এবং তাই অপ্রতিহত মহাকালের সামান্যমাত্র অস্থিরতার ফলেই তা সবই নস্যাৎ হয়ে যাবে। আধুনিক জগতের মহা দুর্ভাগ্য যে, জড়জাগতিক জ্ঞানবিকাশে আমাদের প্রগতি হওয়া সত্ত্বেও, আমাদের অন্তস্থিত শাশ্বত চিরন্তন আত্মার সম্পর্কে নৈরাশ্যজনকভাবেই অজ্ঞতা পোষণ করে চলেছি। যে শাশ্বত আত্মার অনুপস্থিতির ফলে জড় শরীরের সমস্ত মানসিক, দৈহিক এবং চিন্তামূলক প্রচেষ্টা অন্তর্হিত হয়ে যায়, সেটাই হলো সৃষ্টির অস্তিত্বের অপরিহার্য মূল তত্ত্ব। আর এই আত্মার যা কিছু অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন, তাই হলো জীবনের পরম বাঞ্ছিত বস্তু। মানুষের সকল আগ্রহ অনুরাগের মধ্যে এই সর্বশ্রেষ্ঠ বিষয়টিকে আমরা যতদিন অবহেলা করে চলব, ততদিনই বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে, চিকিৎসাশাস্ত্রে, শিল্পকলায়, দর্শনতত্ত্বে, সংস্কৃতি অনুশীলনে, এবং সাহিত্যচর্চায় আমাদের সকল প্রকার সাফল্যই নিতান্ত দ্রুত ক্ষণস্থায়ী বিষয়াদির অর্থহীন চর্চায় ব্যর্থ পর্যবসিত হবে, কোনও দিন আমাদের অভীষ্ট সার্থকতা তথা সিদ্ধিলাভের পথে এগিয়ে যেতে দেবে না।

এই ধরনের ভাবধারার সম্পূর্ণ বৈপরীত্যে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এবং তাঁর অনুগামীদের অনুষ্ঠিত জনকল্যাণকর সেবাকার্যের মাধ্যমে শাশ্বত চিন্ময় আত্মাার পরম সুখ তৃপ্তির প্রত্যক্ষ আয়োজন করা সম্ভব হয়েছে, এবং তার ফলে সকলের জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণ বর্ষিত হয়েছে। আজ অথবা কাল যে অস্থায়ী অনিত্য অস্তিত্বের বিলোপ সাধন অবশ্যম্ভাবী, সেই ধরনের জাগতিক উন্নতি-প্রগতির সাথে শ্রীভগবানের জনকল্যাণ ব্রতের কোন সম্পর্ক নেই। আমাদের মোহনিদ্রা থেকে জাগিয়ে তোলার জন্য, আমাদের অস্তিত্ব পরিশুদ্ধ করবার জন্য উদ্দেশ্যে এবং শাশ্বত চিরন্তন জীবকুলের নিত্য কর্তব্যরূপে ভগবদ্ভক্তির প্রথা স্থাপনার জন্যই মহাপ্রভুর আবির্ভাব।

বৈদিক সংস্কৃতি অনুসারে, মানুষের কর্তব্য– ভগবৎ চেতনা লাভ করা। তাকে জানতে হবে ভগবান কি, এই জড় জগৎ কি, এবং ভগবানের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক। একে বলা হয় ‘শ্রেয়’, বা পরম মঙ্গলময় কার্য।

পরম মহাবদান্যভাবে ভাবিত হয়ে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু চেয়েছিলেন এই কলিযুগের অধঃপতিত জীবকুলের কাছে অনন্য ভগবৎ-প্রেমের সর্বোচ্চ শ্রেয় বিতরণ করবেন, যাতে প্রত্যেক মানুষকে যথার্থ আশ্রয়দানের উদ্দেশ্যে তাঁর ব্রত সফল হতে পারে। তাই, তিনি যে নিঃস্বার্থ মহানুভবতার উদারতা স্বপ্রকাশিত হতে চাইবেন, তাতে কোন বিস্ময় নেই, এবং সেই ভাবধারা বৃক্ষরূপে প্রতিভাত হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন