মহাপ্রভুর বিশ্বব্যাপী হরিনাম সংকীর্তন

 


শ্রীকৃষ্ণচেতন্য মহাপ্রভু যে কিভাবে নিরন্তর পতিত জীবদের উদ্ধার করার চিন্তায় মগ্ন থাকতেন, তা ‘এ দুঃখ অপার’ উক্তিটির মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে। এই উক্তিটি থেকে বোঝা যায় যে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, যিনি স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, তিনি সর্বদা এই জড় জগতের অধঃপতিত জীবদের পোষণ করে অত্যন্ত দুঃখিত হতেন… তাই তিনি সর্বদা চিন্তা করতন, কিভাবে তাদের এই দুর্বিষহ জীবন থেকে উদ্ধার করতে পারা যায়।

সকল জীবেরই জীবনে অত্যাবশ্যকীয় উদ্দেশ্য– পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সাথে লুপ্ত সম্বন্ধ পুনরুদ্ধার করা। আমাদের পরমাত্মা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শুদ্ধ প্রেমভক্তির বিকাশ না হলে অন্তরের বেদনাময় অসন্তোষের অভিজ্ঞতা আমাদের সইতেই হবে– জড় সম্পদের সাফল্য-ঐশ্বর্যে যে যতই ভূষিত হই, ভগবদ্ভক্তির অভাবে জন্মে জন্মে একটি অনিত্য শরীর থেকে আর একটি শরীরে দেহান্তরিত হয়ে জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধির বেদনাময় আবর্তে কষ্ট পেতেই হবে। জীবনের এই দুঃখময় পরিস্থিতি থেকে আমাদের উদ্ধার করবার জন্যেই ভগবদ্ভক্তির কল্পবৃক্ষ রূপে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অবর্তীণ হয়েছিলেন।

আর তা সত্ত্বেও, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু স্বয়ং বিরাজমান থাকলেও, নানা শ্রেণীর মানুষ সুকৌশলে তাঁর নাম-সংকীর্তন আন্দোলনটিকে পরিহার করে চলছিল। বহু নির্বিশেষবাদী, বৃৃথা তার্কিকের দল এবং কর্মফলে প্রত্যাশী কর্মী মানুষ শ্রীচৈতন্যবৃক্ষটির প্রসারমান শাখা-প্রশাখা এবং উপশাখাগুলির বাইরে থাকতে চাইছিল। এই সমস্ত হতভাগ্য মানুষগুলির অবস্থা লক্ষ্য করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর হৃদয়ে অপার দুঃখ অনুভব করেছিলেন। সুগভীর উৎকন্ঠা নিয়ে, মহাপ্রভু চিন্তা করতেন– কিভাবে তাঁদের উদ্ধার করা যেতে পারে, এবং তাই তাঁর ব্রত সাধনের উদ্দেশ্যে নানা প্রকার সার্থক পরিকল্পনার উদ্ভাবন করেছিলেন।

আজও, বিগত দিনের মতোই, লক্ষ লক্ষ মানুষ কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনটিকে পরিহার করে চলতে বেশ পটু। তাই, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তদানীন্তনকালে যেমন সেই ধরনের ‘সুপটু লঙ্ঘনকারী’ মানুষদের দুর্দশায় ব্যথিত হতেন, তেমনই আজও তিনি ‘সুপটু লঙ্ঘনকারী’ মানুষদের দুর্ভাগ্যে সমানভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছেন, তা অনুমান করা মোটেই অযৌক্তিক নয়। যদিও শ্রীচৈতন্য মহাপভু তাঁর দিব্যনাম প্রবর্তন করেছেন তবুও তাঁর সেই ‘অপার দুঃখ’ এখনও বর্তমান এবং তাঁর অহৈতুকী কৃপার পূর্ণ সুযোগ সকলে গ্রহণ না করলে সেই দুঃখের অবসান হতে পারে না। অধঃপতিত জীবের দুর্দশা দর্শন করে মহাপ্রভু যখন দুঃখিত হন, তখন তাঁর ভক্ত তাঁকে সান্তনা দিয়ে বলেন, “প্রভু, আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না।” এইটিই আদর্শ সেবার ভাব। এই আদর্শ অবলম্বনে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উদ্বেগ দূর করা সকলেরই কর্তব্য। যিনি পতিতপাবন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর এই উদ্বেগ দূর করার চেষ্টা করেন, তিনি নিঃসন্দেহে ভগবানের সব চেয়ে অন্তরঙ্গ ভক্ত।

শ্রীভগবানের উদ্বেগ উৎকন্ঠা প্রশমনে যে অন্তরঙ্গ ভক্তি নিষ্ঠা সহকারে সেবা নিবেদন করে, তার যথার্থ মানসিকতা এখানে শ্রীল প্রভুপাদ ব্যক্ত করেছেন। যেভাবে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু এবং শ্রী প্রভুপাদ পতিতজনের উদ্ধারের কথা চিন্তা করেছিলেন, সেই ভাবে আমাদেরও গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত– মহাপ্রভুর সংকীর্তন আন্দোলনে বিমুখ মানুষদের কিভাবে উদ্ধার করা যেতে পারে।

প্রতিটি দিন অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, হাজার হাজার জীবাত্মা একমাত্র চৈতন্যবৃক্ষের মাধ্যমে লভ্য ভগবৎ-প্রেমভক্তির অমৃতময় ফল আস্বাদন করেই এই জগৎ ছেড়ে বিদায় নিচ্ছে, এবং তার ফলে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ‘অপার দুঃখ” বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। তাই কৃষ্ণভাবনামৃত আমাদের বিতরণ করতেই হবে, আর সময় নেই…..

জরুরী মনোভাব আত্মস্থ করা চাই।

যদি প্রত্যেকের মনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে শাশ্বত শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তি সেবার মনোভাব জাগে, তা হলে আপনা হতেই কলি আর্তনাদ করতে করতে দূর হয়ে যাবে।

পাঁচশ বছর আগে, শ্রীচৈতন্য মহপভু ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন যে, তাঁর পবিত্র নাম পৃথিবীর সমস্ত গ্রামে-গঞ্জে শহরে-নগরে প্রচারিত হবে। শাস্ত্রাদিতে এমনও ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে যে, কলিযুগের পাপময় দিনগুলিতে চিন্ময় উপলব্ধির জ্যোতি অন্ধকারাবৃত হয়ে গেলেও শ্রীভগবানের নাম সংকীর্তনের আন্দোলন ১০,০০০ বছর ধরে বিজয়গর্বে সর্বত্র চলতে থাকবে। ‘ভগবান’ কথাটির অর্থ যিনি বোঝেন, তিনিই জানেন যে, পরমেশ্বর ভগবান যা কিছুই ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকেন, তা সবই সত্য প্রতিপন্ন হয়, যেহেতু কোনও যুগেই বা কোনও পরিস্থিতিতেই তাঁর অভিলাষ অবহেলিত হতে পারে না।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অনুগামীরা শ্রীভগবানের অত্যাশ্চর্য বিস্ময়কর, নাটকীয় লীলাস্বরূপ তাঁর নাম সংকীর্তন-লীলারই অনুগামী– এই লীলায় তিনি পরম কৃপাভরে তাঁর দিব্যনাম জপকীর্তন প্রচারের মাধ্যমে কলিযুগের আধিপত্য খর্ব করেছেন।

দুঃসাহসিক কর্মকান্ড সবেমাত্র শুরু হয়েছে। মহাপ্রভুর মহান সেনাধ্যক্ষ শ্রীল প্রভুপাদ সকল দেশেই সুদৃঢ় তথা দুচ্ছেদ্য নোঙর স্থাপন করেছেন, যাতে জগতের সৌভাগ্য সুনিশ্চিত হতে পারে। কিন্তু কলি “আপনা হতেই আর্তনাদ করতে করতে দূর হয়ে যাবে না।”– তাকে দূর করতে হলে ভগবৎ-প্রেমের মহাসমুদ্রে পৃথিবীর প্রত্যেকটি নারী-পুরুষ এবং সন্তানকে পরিপূর্ণভাবে নিমজ্জিত হতেই হবে। শ্রীল প্রভুপাদ তার ‘বৈশিষ্ট্যাকম্’ রচনার মধ্যে ব্যাখ্যা করেছেন যে, “শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাণীর সারমর্ম পিঞ্জরাবদ্ধ করে রেখে সমগ্র জগতকে বধ করাই কলির উদ্দেশ্য।”

আর সেটাই বর্তমান যুগের হালচাল নয়? চমকদার বিজ্ঞানী, দার্শনিক আর রাজনীতিকদের মারাত্মক ভবদর্শনগুলিই গুরুত্ব লাভ করেছে, অথচ ভাগবতের যথার্থ আলোক বর্তিকা হয়ে রয়েছে অন্তর্হিত এবং বিস্মৃত। ফলস্বরূপ– জনগন বিভ্রান্ত, মানব-জীবনের ব্রতসাধন আজ বিধ্বস্ত, এবং জগত নিমজ্জিত হয়েছে অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা আর বিক্ষোভ-বিদ্বেষের দুঃস্বপ্নময় অন্ধকারে।

এমন পরিস্থিতি সংস্কারের মহান ব্রত ন্যাস্ত হয়েছে আমাদের কাছে– শ্রীল প্রভুপাদের শিষ্য-প্রশিষ্যবর্গের হাতে। নোঙর ফেলা হয়ে গেছে, কিন্তু এখন আমাদের সাঙ্গোপাঙ্গবাহিনীকে অবশ্যই কলির রাজ্যে অনুপ্রবেশ করে চলতে হবে এবং ক্রমশই একে একে ভূমি দখল করে যেতে হবে। প্রত্যেকের কাছেই ভগবদ্ভক্তি অনুশীলনের প্রক্রিয়া সহজলভ্য তথা সহজসাধ্য করে তোলার মাধ্যমে ভগবৎ প্রেমের ভান্ডার উজার করে দিতে হবে, কলির লৌহকঠিন কারাপ্রাচীর আমাদের বিধ্বস্ত করে দিতে হবে, যাতে শ্রীভগবানের মূল্যবান উপদেশামৃত মুক্তধারায় জগৎ-কল্যাণে প্রবাহিত হতে থাকে; কলির কবলমুক্ত করতে হবে জণগণকে, ভগবদ্গীতা ও শ্রীমদ্ভাগবতের মহান ভাবোজ্জল উপদেশাবলী তাদের কাছে অবারিত করতে হবে আমাদেরই।

শ্রীল প্রভুপাদের জরুরী অনুরোধ এই যেঃ

দিন যত যাচ্ছে, কলিযুগের প্রভাব ততই বাড়ছে এবং হতভাগ্য জীবকুল দুর্দশায় সকলে আর্তনাদ করছে। বৈষ্ণবজনের কৃপার অভাবে প্রত্যেকেই অসুখী। ভগবদ্ভক্তির চিহ্নমাত্র লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বলে জড়জাগতিক সামগ্রীর ভোগ-ব্যবহারেই সারা পৃথিবীটা পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। তবু, তারা শান্তির খোঁজ করছে। এই কৃষ্ণভাবনামৃত তাদের মধ্যে প্রচার করে, তাদের বাসনা চরিতার্থ করতে হবে। সাগরাদি থেকে, পৃথিবীর প্রান্ত অবধি সমগ্র বিশ্ব পরিব্যাপ্ত করতে হবে। আজই, আমার ভ্রাতৃবর্গ, এই কাজে নিয়োজিত হও। তোমাদের প্রচার অভিযানের মাধ্যমেই নিষ্পেষিত জীবকুলকে রক্ষা করতে হবে।

একটি মুহূর্তও আমাদের আর প্রতীক্ষা করা চলবে না। আজই আমাদের এই কাজে নামতেই হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন