ভ্রুণহত্যা অপরাধ

 ভগবানের চতুর্ভুজ রূপ, তাঁর সোনার কুন্ডল রক্তিম চক্ষু, যখন তিনি দাঁড়িয়েছিলেন তখন তাঁকে আকাশের তারার মতো দেখাচ্ছিল। এইরূপে পরীক্ষিৎ মহারাজ মাতৃগর্ভে ভগবানকে দর্শন করেছিলেন।




ব্রহ্মসংহিতার পঞ্চম অধ্যায়ে বর্ণিত আছে যে ভগবান শ্রীগোবিন্দ পরমাত্মা রূপে তাঁর একটি স্বাংশ প্রকাশের দ্বারা এই জগগতের আলোর মধ্যে প্রবেশ করেন এবং পরমাত্মারূপে প্রতিটি জীবের হৃদয়ের মধ্যে বিরাজ করেন এবং ভৌতিক শক্তির অণুর মধ্যেও থাকেন। তাই ভগবান হচ্ছেন সর্বদাই সর্বত্র বিরাজমান। তিনি তাঁর অচিন্ত্য শক্তি দ্বারা উত্তরা দেবীর গর্ভে প্রবেশ করেছিলেন তাঁর প্রিয় ভক্ত পরীক্ষিত মহারাজকে মহাবিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য।

ভগবদ্গীতায় (৯/৩১) ভগবান প্রতিজ্ঞা করেছেন তাঁর ভক্তের কোন বিনাশ হবে না। কেউ ভগবানের ভক্তকে হত্যা করতে পারে না যেহেতু ভগবান তাকে রক্ষা করেন এবং ভগবান যাকে মারতে চান কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না। ভগবান হচ্ছেন সর্বশক্তিমান, সেইজন্য তিনি রক্ষা বা নিহত তাঁর ইচ্ছামতো করতে পারেন। তিনি তাঁর ভক্ত মহরাজ পরীক্ষিৎকে দর্শন দিয়েছেন যখন পরীক্ষিৎ তার মাতৃগর্ভে বিপদগ্রস্ত ছিলেন, ভগবান তাঁকে ক্ষুদ্র আকার ধারণ করে দেখা দিয়েছিলেন, কেন না ভগবান বহুগুণে বড় এবং অনুর চেয়েও ক্ষুদ্র আকার একই সঙ্গে ধারণ করতে পারেন। তিনি দয়াল ঠাকুর এবং তিনি তাঁর সীমিত বদ্ধ জীবদের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ রূপ গ্রহণ করতে পারেন যাতে তারা তাঁকে দর্শন করতে পারেন। তিনি হচ্ছেন অপরিসীম এবং আমাদের চিন্তার থেকেও তিনি অধিক বিশাল এবং ক্ষুদ্র। তিনি হচ্ছেন সর্বশক্তিমান প্রভু। উত্তরার গর্ভে দর্শনধারী এবং বৈকুন্ঠধামের নারায়ণের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। ভগবানের অশেষ কৃপার দ্বারা এই ভৌতিক জগতের জীবদের কাছে তিনি অর্চা-বিগ্রহরূপে প্রকাশিত হয়েছেন। তার ফলে বদ্ধ জীবগণ তাঁর সেবা লাভ করে ভগবানের কৃপা লাভ করতে পারেন। ভগবানের আদিরূপ আমাদের জড় ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব করা অসম্ভব। সেই অর্চা-বিগ্রহ একটি সর্ব আধ্যাত্মিক রূপ যার দ্বারা বদ্ধ জীবগণ সহজেই ভগবানের দর্শন লাভ করতে পারে। আমাদের কখনও ভাবা উচিত নয় যে ভগবানের অর্চাবিগ্রহ হচ্ছে এই জড় জগতের প্রাকৃত বস্তু। ভগবানের কাছে জড়া এবং আধ্যাত্মিক শক্তির মধ্যে কেন পার্থক্য নেই। আমাদের কাছে যদিও বা এক বিরাট পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু ভগবানের পক্ষে সব কিছুরই আধ্যাত্মিক পরিবেশ রয়েছে।

মাতৃগর্ভস্থ পরীক্ষিৎ মহারাজকে হত্যা করার জন্য অশ্বথামা ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করল। উত্তরাদেবী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে হে দেব দেব! হে ভগবান! হে জগৎপতি! সম্বোধন করে প্রার্থনা করে ভগবানের কাছে আশ্রয় নিলেন এবং বললেন, “হে ভগবান, আমাকে হত্যা করুন তাতে আমার কোন দুঃখ নেই, কিন্তু আমার সন্তান যেন নষ্ট না হয়।”

এইটি ছিল আমাদের বৈদিক সংস্কৃতি। মায়েরা এমন দায়িত্বশীল যে তাদের নিজের সন্তানকে রক্ষা করার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে তারা প্রস্তুত ছিলেন। তখন উত্তরাদেবী ভেবেছিলেন যে, “আমি মরে গেলেও আমার সন্তানকে বাঁচাতে হবে, যওি আমার গর্ভের মধ্যে আছে।” তাই তিনি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলেন যে আমার জন্য আমি প্রার্থনা করছি না, কেন না ভক্তরা কখনও ভগবানের কাছে নিজের জন্য প্রার্থনা করেন না। তারা সব সময় ভগবানের সেবার জন্য এবং অপরের জন্য প্রার্থনা করেন। এই জন্য উত্তরাদেবী প্রার্থনা করলেন যে তার গর্ভস্থ সন্তান যেন নষ্ট না হয়, কারণ সে ভগবানের ভক্ত হবে।

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা চিন্তা করা দরকার যে এমন একটি কুসংস্কার ঢুকে গেছে আমাদের মধ্যে যে আধুনিক প্রভাবের জন্য বিভিন্ন রকম নাস্তিকদের ভুল ভ্রান্তির জন্য এখন মায়েরা নিজেরাই স্বীকার হচ্ছেন ভ্রণ হত্যা করার জন্য। সাধু ঋষিরা আগে কোন দিন কল্পনা করতে পারেনি যে একজন মা তার নিজের সন্তানকে হত্যা করেন। আমাদের বেদ শাস্ত্র বলে যে, সন্তান যখন গর্ভে আসে তখন সে জীবিত। যখন স্ত্রী-পুরুষের মিলন হয় এবং গর্ভের মধ্যে প্রথম দিনে দুটি বীজ এক সঙ্গে মিলন হয় তখন থেকেই জীবের সঞ্চার হয়। সেই জীবকে গর্ভ থেকে অসাধারণভাবে হত্যা করাকে শাস্ত্রে মহাপাপ বলা হয়।

হিরণকশিপু যখন তপস্যা করছিলেন সে সময় তার স্ত্রী গর্ভবতী ছিল; তখন দেবগণ ভেবেছেন যে হিরণ্যকশিপু মস্ত বড় অসুর ভবিষ্যতে কি কষ্টই বা সে আমাদের দেবে এবং তার যদি সন্তান জন্মে তাহলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলব, তা না হলে ভবিষ্যতে না জানি আমাদের কত কষ্টই না হবে। তারা বাচ্চাকে মারতে রাজি কিন্তু ভ্রুণ হত্যা করতে রাজি হয়নি। ভ্রুণ হত্যা করা পাপ বলে দেবগণ পর্যন্ত ভয় পেয়েছিল।

প্রহ্লাদ মহারাজের জন্মের আগে থেকেই দেবগণ তার মাকে আটক করে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু নারদমুনি তাঁর মাকে বলেছিলেন কোন রকম ভয় করবেন না। হিরণ্যকশিপুর সন্তান হবে মহা ভাগবত ভক্ত। তাই ঐ সময়ে হিরণ্যকশিপুর স্ত্রী কয়াধু গর্ভবতী থাকাকালে নারদ মুনির নিকট ভাগবত কথা শ্রবণ করেছিলেন। তখন প্রহ্লাদ মাতৃগর্ভে থেকে ভাগবত কথা শ্রবণ করে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করেন। কিন্তু যদিও কয়াধু হরি কথা শ্রবণ করেছেন কিন্তু পরবর্তীকালে অসৎ সঙ্গের প্রভাবে তা ভুলে যান কিন্তু প্রহ্লাদ কখনও ভুলে যাননি।

আগে মানুষের স্মরণ শক্তি খুব বেশি ছিল এবং হয়ত অনেক স্ত্রী লোকেরাও ভাল স্মরণ শক্তি ছিল আবার কখনও তারা হয়ত ভুলে যায়। কিন্তু আজকাল স্ত্রী-পুরুষ সবাই খুব সহজেই ভুলে যায় এবং অল্প সংখ্যক লোকই কিছু মনে রাখতে পারে। তার জন্য ব্যাসদেব আমাদের জন্য বেদ লিখেছেন, যাতে প্রতিদিন হরিকথা শ্রবণ করতে পারি। আমরা যদি প্রতিদিন গীতা ভাগবত শ্রবণ না করি তা হলে আমরা আস্তে আস্তে সব ভুলে যাই, ভুলে গিয়ে অন্ধকার মহামায়ার মধ্যে আমরা ডুবে থাকি।

সে জন্য ভাগবতে আছে, নিত্যং ভাগবত সেবয়া– আমাদের প্রতিদিন শ্রীমদ্ভাগবত অধ্যয়ন এবং সদ্গুরুর আনুগত্যে সেবা করার বিশেষ কর্তব্য রয়েছে। এইভবে কয়াধুর গর্ভে প্রহ্লাদের জন্ম হয় এবং তাঁর লীলা কাহিনী আপনারা নিশ্চয়ই জানেন।

ঠিক এইভাবে উত্তরাদেবী তার সন্তানকে বাঁচাতে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলেন এবং কৃষ্ণ তার গর্ভে পরমাত্মার মতো রূপ গ্রহণ করে প্রবেশ করে পরীক্ষিৎ মহারাজকে দর্শন দিলেন। পরীক্ষিত নাম হল কেননা পরীক্ষিত মহারাজ যে রূপ দর্শন পেয়েছেন গর্ভের মধ্যে, তিনি সব সময় খুঁজছেন তার প্রভুকে দর্শন পাবার জন্য। সেইজন্য প্রত্যেক মানুষের মুখের দিকে পরীক্ষিৎ মহারাজ তাকিয়ে দেখতেন এই সেই পরম পুরুষ ভগবান কিনা। তার কখনও ভুল হয়নি। সব সময় খুঁজে খুঁজে পরীক্ষা  করছেন। কোথায় ভগবান। তার জন্য তার নাম হল পরীক্ষিৎ। তিনি সব সময় সব কিছু পরীক্ষা করছেন আবার যদি সেই ভগবানকে দর্শন পাওয়া যায়। সেই তার কামনা ছিল।

আমরা আশা করি যে ভবিষ্যতে ভারতবর্ষের মানুষরা বুঝবে যে সত্যিকারের ভ্রুণ হত্যা হচ্ছে এক বিরাট পাপ এবং এই সব কাজ করা খুব খারাপ যদিও সরকার সেটা অনুমোদন করছেন তাঁর নাস্তিক প্রভাবে। আসলে কোন ধর্ম সেটা অনুমোদন করে না। মানুষ ভুল ভ্রান্তি করে মহাপাপ করছে ফলে ভবিষ্যতে অনেক দুঃখ-কষ্ট তারা পাবে। সেই কষ্ঠ যাতে না পায় তার জন্য আমি এইটুকু বললাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন