রাধাকৃষ্ণের মিলিত তনু হলেন শ্রীগৌরাঙ্গ

 রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধারী।



অনন্যে বিলাসে রস আস্বাদন করি ॥
“শ্রীমতি রাধারাণী এবং শ্রীকৃষ্ণ এক ও অভিন্ন। কিন্তু তাঁরা পৃথক দুটি দেহ ধারণ করেছেন। এভাবেই তারা পরস্পরের প্রেমরস আস্বাদন করেন।”

এই শ্লোকের তাৎপর্যে শ্রীল প্রভুপাদ বলছেন এই শ্লোক স্বরূপ দামোদরের কড়চা থেকে তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে–রাধা-কৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি। দুজনেই এক। একজন শক্তিমান এবং একজন শক্তি। ভগবান এবং তাঁর শক্তি অভিন্ন। “অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্ব” যেভাবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু উপদেশ দিয়েছেন অচিন্ত্য তত্ত্ব, কিভাবে ভগবান এবং তাঁর শক্তি ভেদ ও অভেদ। অন্তরঙ্গা শক্তি তিন প্রকার বর্ণনা করা হয়েছে–সৎ, চিৎ এবং আনন্দ। সৎ মানে অস্তিত্ব। বিভিন্ন জগৎ রয়েছে–জড় জগৎ, চিন্ময় জগৎ, ব্রহ্মজ্যোতি। ভগবানের বিভিন্ন লীলা প্রকাশ ভগবানের সৎ শক্তিকে আরও বিকাশ করে সেটা হল চিৎ বা সম্বিত। পূর্ণ জ্ঞান ভগবানের বহু রূপ আছে মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, বিভিন্ন লীলাবতার, বৈকুন্ঠে বিভিন্ন নারায়ণ আছেন, ভগবানের বৈভব প্রকাশে এইভাবে বিভিন্ন  রূপ থাকে ভগবানের এবং সম্বিত শক্তি থেকে সেই সব রূপ বিকশিত হয়। শক্তি যখন শক্তিমান বা ভগবানকে আনন্দ দান করেন তখন সেই শক্তিকে বলা হয় হ্লাদিনী শক্তি। সৎ শক্তি, সম্বিত বা চিৎ শক্তি, হ্লাদিনী বা আনন্দদায়ী শক্তি। এইভাবে ভগবানের শক্তির তিনটি ভাগ আছে। আমাদের শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে জানতে হলে রাধা-কৃষ্ণকে জানা দরকার। কৃষ্ণ প্রকাশ করেন রাধা। কৃষ্ণ পুরুষ, রাধা শক্তি। শক্তিমান ও শক্তি। এক আত্মা দুটো দেহ, মনে হচ্ছে রাধার আনন্দ বেশী। রাধার আনন্দ যে পায় সে কৃষ্ণকে সেবা করে।। কৃষ্ণ তো আনন্দ পাচ্ছেন। তার চেয়ে কৃষ্ণের সেবা করে রাধা আরও বেশী আনন্দ পাচ্ছেন। এজন্য কৃষ্ণ ঐ আনন্দকে আস্বাদন করার জন্য রাধার ভাবঅঙ্গীকার করে কলিযুগে গৌরাঙ্গ রূপে আবির্ভূত হলেন। এই নবদ্বীপ ধাম রাধারাণী তৈরি করলেন। এখানে ভগবানের সেবা ভাব প্রধান এবং ভগবান যখন এখানে আসেন তিনি সেবা ভাব নিয়ে আসেন এবং তাঁর ভাব ভগবানের সেবা করা। বৃন্দাবনে কৃষ্ণ তো প্রভু। কৃষ্ণ পুরুষ, তিনি লীলা করেন। সবাই কৃষ্ণের সেবা করে। কিন্তু কৃষ্ণ যখন এখানে আসলেন তখন রাধারাণীর ভাব অনুশীলন করে কৃষ্ণকে সেবা করলেন। কৃষ্ণ কৃষ্ণকে সেবা করে। গৌরাঙ্গের লীলা বুঝতে হলে রাধা-কৃষ্ণের মহিমা জানা দরকার। প্রভুপাদ বলছেন যে ভক্তরা রাধা-কৃষ্ণের অন্তরঙ্গ লীলা বুঝতে পারেন। কিন্তু যারা মায়াবাদী তারা সহজে বুঝতে পারে না। মায়াবাদী যদি এক মহা ভগবৎ ভক্তের সাহায্য না পায় তারা বুঝতে পারবে না। কেননা মায়াবাদী মনে করে যে ভগবানের রূপ এই জড় জগতের শক্তি মতো। তারা জানে না ভগবানের একটি চিন্ময় রূপ আছে। তারা মনে করছে নিরাকার হচ্ছে প্রধান। আর সেই নিরাকারটিকে ভগবানের সত্ত্বগুণে ভগবানের কোন একটা রূপ প্রকাশ করেন। কেননা পরমব্রহ্মের কোন রূপ তো থাকতে পারে না। এই হচ্ছে তাদের ভুল ধারণা।

একবার আমি মুম্বাই এয়ারপোর্টে বসেছিলাম, একটা সাদা কাপড় পরা বিধবা বয়স্ক মহিলা আমার পাশে এসে বসে বলে ‘আপনার মন্দিরটা খুব ভালো। কিন্তু আসলে আমি বুঝতে পারি না কেন আপনারা বিগ্রহ পূজা করেন। পরমব্রহ্ম তো নিরাকার। তাহলে আকার ধরে পূজা করেন কেন। আমি আপনার লাইফ মেম্বার।’ আমি অবাক হয়ে গিয়েছি। লাইফ মেম্বার হয়ে কোন মায়াবাদী ওনাকে বলে যে নিরাকার হচ্ছে প্রধান। সেইজন্য তারা রাধা-কৃষ্ণের মহিমা বুঝতে পারে না। হয়তো তারা মনে করতে পারে যে রাধাকৃষ্ণ জড়জাগতিক কোন ব্যাপার। কিন্তু তা নয়, রাধা-কৃষ্ণ চিন্ময় বস্তু। প্রভুপাদ একবার আমাকে জগন্নাথপুরী পাঠিয়েছিলেন কিভাবে ইসকনের বিদেশী ভক্ত জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করে জগন্নাথের দর্শন পাবে। আমি মিনিষ্টারের অফিসারকে বলেছি। তিনি বললেন আমার তো কোন ক্ষমতা নেই, আমি রামকৃষ্ণ মিশনে থাকি। রামকৃষ্ণ মিশনে গেলাম, ওনারা বলছে যে আমাদের কথায় চলে না। পুরীর শঙ্করাচার্য হচ্ছেন এখানকার গুরু, উনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আপনারা যেতে পারবেন, আপনি তার কাছে যান। তার কাছে গেলাম, উনি অবশ্য মহারাজ, সন্ন্যাসী। তার পাশে অষ্টধাতুর তৈরী রাধা-কৃষ্ণ বিগ্রহ ছিল। আমি চিন্তা করলাম ইনি মায়াবাদী আবার রাধাকৃষ্ণ! মনে পড়েছে শ্রীল প্রভুপাদও বলেছেন যে, মায়াবাদীদের পথ খুব শুকনো পথ। সেই জন্য অনেক সময় রাধা-কৃষ্ণ লীলা বলে, রাধাকৃষ্ণ পূজা করে। কিন্তু আসলে রাধাকৃষ্ণকে বোঝার জন্য তাদের অধিকার নেই। কেননা ভক্ত নয়, কিন্তু কিছু রস পাওয়ার চেষ্টা করছে। আমি গেলাম এবং বললাম, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন “পৃথিবীতে আছে যত নগরাদি গ্রাম, সর্বত্র প্রচারিত হইবে মোর নাম”। এখন সারা পৃথিবীতে গৌরের নাম কীর্তন করে এমন অনেক ভক্ত আছে। শ্রীচৈতন্যদেব সেই ভবিষ্যৎ বাণী জগন্নাথপুরীতে বসে বলেছিলেন। আমার গুরুদেব চান যে ওনার শিষ্য ভক্ত যাতে জগন্নাথদেবের দর্শন পায়। সেই শঙ্করাচার্য সন্ন্যাসী বলছে ঠিক আছে দর্শন পাবে, সারা জীবন ভগবানের সেবা কর, ধর্ম কর। যখন মরে গিয়ে পরের জন্মে হিন্দু হবে তখন জগন্নাথের দর্শন পাবে। দেখছি যে ওনার সঙ্গে কথা বলা বেকার হচ্ছে। আমি বললাম যে, আপনি রাধাকৃষ্ণকে পূজা করেন? বলল যে হ্যাঁ, আমিইতো রাধাকৃষ্ণ। আমি রাধাকৃষ্ণকে পূজা করি, তার অর্থ হল আমি আমাকেই পূজা করছি। আমি বললাম যে রাধা-কৃষ্ণ যুগলকিশোর কত সুন্দর সুন্দরী, আর আপনি দাড়িওয়ালা। তিনি বললেন, হ্যাঁ আমি সুন্দর নই, কিন্তু এ আমার লীলা। আমি বললাম, এরকম লীলাতো সবাই করছে। সাবই বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তারা যুগল, নিত্য যৌবন, আপনি যদি সেরকম হতেন তাহলে কিছুটা বিশ্বাস হতো। কিছুই বুঝে না রাধাকৃষ্ণের সেবা ব্যাপারে। এমন যিনি শঙ্করাচার্য আছেন তার কি মত আমি জানি না। খবর পাওয়া গেছে যে, ওদেরকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বলেছে যে, ইসকনের ভক্তদের জগন্নাথ মন্দিরে যেতে দেওয়া উচিত। তো আমাদের সারা পৃথিবীতে শত শত জগন্নাথ, বলদেব, সুভদ্রা মন্দির আছে। ১০০ এর উপর রথ হচ্ছে।

রাধাকৃষ্ণকে বুঝতে হলে কৃষ্ণভক্ত হতে হবে। একটা উদাহরণ আছে একটা গ্লাসের বোতলে মধু ছিল। মৌমাছি এই মধুর ঘ্রাণ পেল, মৌমাছি বুঝতে পারছে যে সেটা কাঁচ। বাইরে থেকে দেখছে কাঁচে মধু, তো সে মনে ভাবল যে আমি মধুতে লাফ মরাব। কিন্তু মাথা লেগেছে কাঁচে, কি হল! এত শক্ত মধু। একবার, দুবার তিনবার এভাবে বার বার চেষ্টা করছে, তো মাথা ঘুরাচ্ছে। তখন বোতলের উপরের টুপিটাতে বসে পড়ল এবং পুরো ঘ্রান নিল এবং ভাবল যে হ্যাঁ, এবার মধু খেয়েছি। তখন মাথা তার ঘুরছে, তাই সে বুঝতে পারেনি যে মধু তো পাইনি মধুর ঘ্রাণ পাচ্ছি। মায়াবাদীরা হচ্ছে এরকম, তারা রাধাকৃষ্ণের  রস পেতে চায়। বার বার চেষ্টা করছে কিন্তু বুঝতে পারছে না। কারণ তাদের ধারণা তো ভুল-ভগবান নিরাকার। কৃষ্ণ সচ্চিদানন্দ। তাঁর শক্তি প্রকাশ হয় তার সেবা করার জন্য, সেটা মায়াবাদীরা বুঝতে পারেনা। তারা মনে করে বুঝতে পেরেছি, কিন্তু বাস্তবে তারা কিছুই বুঝতে পারেনি। যারা বুঝতে চায় তাদের ভক্তিযোগ করতে হবে, শুদ্ধ ভক্তের কাছে শুনতে হবে। শুদ্ধ ভক্ত জানে রাধা ও কৃষ্ণ নিত্য চিন্ময় বস্তু।

রাধারাণী চায় কৃষ্ণকে পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট করতে আর কৃষ্ণ চায় তার প্রিয় ভক্ত শ্রীমতী রাধারাণীকে খুশি করতে, দুজনের মধ্যে প্রতিযোগীতা। অনন্য ভক্ত কৃষ্ণকে সবসময় জয় করতে পারে এবং কৃষ্ণ একটু আশীর্বাদ দিল কিন্তু রাধারাণী এত সুদক্ষা তিনি কৃষ্ণকে অনেক সময় জয় করেন। একবার কৃষ্ণ লুকিয়ে গেছেন গোপীদের থেকে, আর গোপীরা খুঁজছে কোথায় কৃষ্ণ? কোথায় কৃষ্ণ? দেখছেন কৃষ্ণ একটা পাথরের উপর বসেছিলেন। সেখানে কৃষ্ণকে দেখে সবাই গিয়েছে কৃষ্ণের কাছে আর কৃষ্ণ ভাবছেন আর তো পালাতে পারবো না। কৃষ্ণ তখন চতুর্ভুজ রূপ ধারণ করেছেন, গোপীরা বলছেন ও এতো কৃষ্ণ নয়, নারায়ণ। সাধারণত কোন ভক্ত যদি নারায়ণ দেখতে পায় সে মনে ভাবে তার জীবন সার্থক হয়েছে নারায়ণ দর্শণ হয়ে গেছে। কিন্তু গোপীকারা নারায়ণ দর্শন করেও ভাবছে কোথায় কৃষ্ণ। এক গোপী প্রনাম করে বলছে কৃষ্ণ কোথায় পালিয়ে গেছে। যখন রাধারাণী এসেছেন, তখন কৃষ্ণের চতুর্ভজ দেখতে পাচ্ছে না। রাধা-কৃষ্ণ ভিন্ন, তো রাধার ইচ্ছা কৃষ্ণকে খুশি করা, কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করা। রাধাকে দেখে কৃষ্ণ চতুর্ভুজ রূপ রাখতে পারলেন না, দ্বিভুজ হলেন। রাধারাণীর জয় হলো।
কুরুক্ষেত্রে রাধারাণীর সঙ্গে যখন কৃষ্ণের মিলন হলো, রাধারাণী সেখানেই খুশি হলেন না। এই রাজ পোশাক হাতি ঘোড়া। বৃন্দাবনে যে আনন্দ আছে এখানে তার একঅংশও নেই। আমরা কৃষ্ণকে নিয়ে যাব বৃন্দাবনে। সেখানে কেলি কদম্ব যমুনার তীরে সেই সব গাছের দিকে তাকালে আনন্দ পাবে। ঐভাবে রথযাত্রা শুরু হলো। কৃষ্ণকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যমুনার তীরে বৃন্দাবনে।

যদি কেউ মনে করে যে রাধাকৃষ্ণের লীলা জড় জগতের স্ত্রী পুরুষের সম্পর্কের মতো, তবে তা মহা অপরাধ। বাইরে হয়তো সেরকম দেখতে কিন্তু গভীর ভাবে দেখলে সেরকম নয়। রাধা কৃষ্ণের সমস্ত লীলা আমাদের মনে রাখতে হবে, এগুলো হচ্ছে সচ্চিদানন্দ ব্যাপার, জড় জগতের ব্যাপার নয়। আজকের শ্লোকে আমরা রাধা-কৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ, রাধা কৃষ্ণ থেকে প্রকাশিত। অন্তরঙ্গা শক্তি রাধারাণী হচ্ছে মহামায়ার উৎস, সেইজন্য রাধারাণী মায়ার দ্বারা আবদ্ধ হতে পারে না। আমরা জীব শক্তি, আমরা রাধার থেকে আনবিক শক্তি, তাই আমরা মায়ার মধ্যে পড়তে পারি। আমরা যদি অন্তরঙ্গা শক্তির আশ্রয় পাই তবে ভগবানের নিত্য সেবায় যুক্ত হতে পারবো। আমরা যদি অন্তরঙ্গা শক্তির আশ্রয় ছেড়ে দিয়ে বহিরঙ্গা শক্তির আশ্রয়ে থাকি, তবে আমরা মায়ামগ্ন জীব হয়ে থাকবো। আমরা রাধারাণীর কৃপার প্রভাবে কৃষ্ণকে সেব্য রূপে দেখছি যেইভাবে শ্রীচৈতন্যদেব সেবা করলেন। কৃষ্ণপ্রেম স্বরূপিনী রাধাঠাকুরাণী।

শ্রীমদ্ভাগবতে রাধারাণীর ভাব সম্বন্ধে সরাসরি বলা হয়েছে যারা আমাদের উপদেষ্টা তারা হলেন যে শ্রীল শুকদেব গোস্বামী যদি রাধানাম উচ্চারণ করতেন তবে তাঁর অষ্টসাত্ত্বিক বিকার হতো, এবং সাতদিনে শ্রীমদ্ভাগবত শেষ হতো না, স্তব্ধ হয়ে যেতো। সেজন্য ঘুরে ফিরে ‘এক প্রধান গোপী’ আছে, সে কৃষ্ণকে ভালভাবে আরাধনা করতে পেরেছে। অসংখ্য পুরাণ আছে যেখানে রাধার সম্বন্ধে বেশী বলা আছে। রাধাষ্টমী মাহাত্ম্য পদ্মপুরাণে আছে। ভক্তিরসামৃতসিন্ধুতে রাধাষ্টমী মাহাত্ম্য সম্বন্ধে অনেক কিছু লেখা আছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন