বিপত্তিপূর্ণ বিশ্বে শান্তির আস্বাদন

  বৈদিক শাস্ত্রসমূহ আমাদের সেই জ্ঞান দান করে, যা আমাদের মনকে সুস্পষ্ট এবং স্বচ্ছ করে দিতে পারে, এবং জীবনের পরম লক্ষ্যের পথে আমাদের প্রতিষ্ঠিত করে।



প্রাচীন ভারতের এক কলহপূর্ণ যুগে মহারাণী কুন্তী এবং তাঁর পঞ্চ-পুত্রকে অনেক দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।  তাঁদের শত্রুরা তাঁদের রাজ্যচ্যুত করেছিল, তাঁদের বিষ খাইয়ে প্রাণনাশ করার চেষ্টা করেছিল এবং জতুগৃহে তাঁদের পুড়িয়ে মারবার চক্রান্ত করেছিল।  কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সব সময় তাঁদের রক্ষা করেছিলেন এবং তার ফলে তাঁর প্রতি মহারাণী কুন্তীর ভক্তি ক্রমান্বয়ে গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠেছিল।

বিপদঃ সন্তু তাঃ শশ্বত্তত্র তত্র জগদ্গুরো।

ভবতো দর্শনং যৎ স্যাদপুনর্ভবদর্শনম্ ॥ (ভাঃ ১/৮/২৫)

মহারাণী কুন্তী বললেন, “আমি চাই সেই সমস্ত বিপত্তিগুলি বারবার আসুক, যাতে আমরা বারবার তোমাকে দর্শণ করতে পারি।  কারণ তোমাকে দর্শন করার ফলে আর পুনঃ পুনঃ জন্ম এবং মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হয় না। ”


বিপত্তিপূর্ণ এই বিশ্বে মানুষ প্রতিনিয়তই নানা রকমের দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হচ্ছে।  কিন্তু তারা যদি ভগবানের চরণাশ্রয় গ্রহণ করে ভগবদনুশীলনে ব্রতী হয় (বিশেষ করে এই কলিযুগে হরিণাম সংকীর্তনের মাধ্যমে), তা হলে তারা অনায়াসে দুঃখ-কষ্টের সীমা অতিক্রম করে পরম আনন্দময় সেই চিন্ময় ধামের দিকে অগ্রসর হতে পারে, সেখানে তারা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিত্য-লীলায় প্রবিষ্ট হয়ে যথার্থ শান্তির স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে।


ভগবদ্গীতায় ভগবান এই জড় জগৎকে ‘বিপদসমূহে পরিপূর্ণ এক ভয়ঙ্কর স্থান’ বলে বর্ণনা করেছেন।  এই জড় জগৎ স্বাভাবিকভাবেই নানা রকম দুঃখ-দুর্দশা এবং বিপত্তিতে পরিপূর্ণ।  অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা এই সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা এবং বিপত্তির কবল থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য নানা রকম পরিকল্পনা করে।  কিন্তু তারা জানে না যে, এই জড় জগৎ হচ্ছে দুঃখময়।  এই জড় জগতের উর্ধ্বে দুঃখ এবং সব রকম বিপত্তি-বিহীন, পূর্ণ আনন্দময় যে ভগবদ্ধাম রয়েছে, সেই সম্বন্ধে তাদের কোনই জ্ঞান নেই।


যথার্থ বুদ্ধিমান মানুষদের কর্তব্য হচ্ছে দুঃখ-দুর্দশাপূর্ণ এই জড় জগতের সব রকম পরিস্থিতিতে নিরুদ্বিগ্ন হয়ে থাকা, সুখ এবং দুঃখ উভয় অবস্থাতেই অবিচলিত থেকে পারমার্থিক জ্ঞানের অন্বেষণ করা, কারণ সেটিই হচ্ছে মানব-জীবনের পরম লক্ষ্য।


সংকটের সমুদ্র

জীবাত্মা সব রকমের ভৌত বিপত্তির অতীত, তাই তথাকথিত বিপত্তিগুলিকে অলীক বলে বর্ণনা করা হয়।  কোন মানুষ যখন স্বপ্নে দেখে যে, একটি বাঘ তাকে খেতে আসছে, তখন ভয়ে সে আর্তনাদ করে ওঠে।  কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেখানে কোন বাঘ নেই এবং বিপদের কোনই আশঙ্কা নেই– সে কেবল স্বপ্নে তা কল্পনা করেছে।  তেমনই, জীবনের সব রকম বিপত্তিগুলিকে স্বপ্ন বলা হয়।  যদি কেউ ভক্তিযুক্ত সেবার দ্বারা ভগবানের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে, তা হলে সেটি হচ্ছে পরম প্রাপ্তি।  ভক্তির ন’টি অঙ্গের যে-কোন একটির দ্বারা ভগবানের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে আমরা ভগবানের কাছে ফিরে যেতে পারি।


এই শ্লোকটিতে অত্যন্ত সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, দুঃখ-দুর্দশা এবং সঙ্কট যদি আমাদের শ্রীকৃষ্ণের কথা মনে করিয়ে দেয়, তা হলে সেই সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা, সেই সমস্ত সঙ্কট অত্যন্ত লাভপ্রদ।  সঙ্কট অবশ্যই আসবে, কারণ এই জড় জগৎ সঙ্কটে পরিপূর্ণ।  কিন্তু যে সমস্ত মানুষেরা তা জানে না, তারা এই সঙ্কট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নানা রকম জাগতিক প্রয়াস করে।  প্রতিটি জীবই আত্যন্তিক সুখ, পরম আনন্দ প্রাপ্তির প্রয়াস করে।  কার্যরত ব্যক্তি মনে করে, “এখন আমি অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে ব্যাঙ্কে অনেক টাকা জমাব, যাতে বৃদ্ধ অবস্থায় কোন কিছু না করে আমি সুখভোগ করতে পারি। ” প্রতিটি মানুষের এটিই হচ্ছে আন্তরিক অভিপ্রায়।  কেউই কাজ করতে চায় না; যখনই কেউ একটু ধন প্রাপ্ত হয়, তখনই কার্য থেকে অবসর গ্রহণ করে সুখী হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তা সম্ভব হয় না।  মানুষ এইভাবে সুখী হতে পারে না।


এখানে কুন্তী দেবী অপুনর্ভবদর্শনম্ বিষয় সম্বন্ধে বলেছেন।  ‘অ’– এই শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘না’ এবং ‘পুনর্ভব’ কথাটির অর্থ হচ্ছে ‘জন্ম এবং মৃত্যুর বারংবার প্রাপ্তি’।  এই জন্ম এবং মৃত্যুর বারংবার প্রাপ্তি হচ্ছে বাস্তবিক সঙ্কট।  এটি বন্ধ করতে হবে।


ভৌত জগত সঙ্কটে পরিপূর্ণ (পদং পদং যদ্ বিপদং)।  দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, কেউ যদি এক অত্যন্ত শক্তিমালী জলযান করেও সমুদ্রে পাড়ি দেয়, তবুও সেই জলযান কখনই সম্পূর্ণ নিরাপদ হতে পারে না।  মানুষটি সাগরে রয়েছে, যে-কোন মুহূর্তে সঙ্কট আসতে পারে।  ‘টাইটানিক’ জলযান অত্যন্ত সুরক্ষিত ছিল, কিন্তু তার প্রথম যাত্রাতেই তা ডুবে গিয়েছিল এবং পৃথিবীর বহু বিখ্যাত মানুষ এই দূর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল।  সুতরাং সঙ্কট তো আসবেই, কারণ আমরা এক অত্যন্ত সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতিতে রয়েছি।  এই ভৌত সংসার সঙ্কটে পরিপূর্ণ।


তাই আমাদের যত শ্রীঘ্র সম্ভব এই সঙ্কটের সমুদ্র পার হতে হবে।  সেটিই আমাদের জীবনের পরম লক্ষ্য হওয়া উচিত।  যতক্ষণ আমরা সমুদ্রে রয়েছি, আমাদের জলযান যত শক্তিশালীই হোক না কেন, ততক্ষণ আমাদের অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটপূর্ণ।  এটি বাস্তব সত্য, তাই সাগরে তরঙ্গের প্রভাবে অশান্ত না হয়ে আমাদের সাগর পার হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সেটিই আমাদের জীবনের পরম কর্তব্য।


যতক্ষণ আমরা এই ভৌত জগতে রয়েছি, ততক্ষণ বিপদ আসবেই, কারণ এটি একটি বিপদসঙ্কুল স্থান।  কিন্তু এই সমস্ত বিপত্তি সত্ত্বেও আমাদের কর্তব্য হচ্ছে আমাদের হৃদয়ে কৃষ্ণভাবনামৃত বিকশিত করা, যাতে এই দেহ ত্যাগ করার পর আমরা আমাদের প্রকৃত আলয় ভগবদ্ধামে শ্রীকৃষ্ণের কাছে ফিরে যেতে পারি।


একটি সুখাবহ আদেশ

কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বলেছিলেন, “তুমি যা কিছু বলছ, তা সবই সত্য।  আমি এই শরীর নই।  আমি আত্মা; এবং প্রতিটি জীবই তার প্রকৃত স্বরূপে আত্মা।  যখন এই শরীর নষ্ট হয়ে যাবে, তখনও আত্মার অস্তিত্ব থাকবে। কিন্তু যখন আমি দেখি যে, আমার পুত্রের মৃত্যু হচ্ছে অথবা আমার পিতামহের মৃত্যু হচ্ছে এবং আমি হত্যা করছি, তখন আমি কিভবে এটি মনে করে সন্তুষ্ট থাকতে পারি যে, তাদের মৃত্যু হচ্ছে না, কেবল তাদের শরীরের পরিবর্তন হচ্ছে ? এই শরীরকে আশ্রয় করে তাদের প্রতি আমার স্নেহ এবং ভালবাসা বিকশিত হয়েছে।  সুতরাং দুঃখ এবং শোক হওয়াটা স্বাভাবিক। ”


শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের এই উক্তি অস্বীকার করেননি।  তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “হ্যাঁ, তা সত্য।  কেননা তুমি ‘আমি এই শরীর’– এই ধারণায় স্থিত হয়েছ, তাই তোমার শোক হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে তা তোমাকে সহ্য করতে হবে।  এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ” যেমন, ভগবদ্গীতায় (২/১৪) শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন–

মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ

আগমাপায়িনোহনিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত ॥

“হে কুন্তীপুত্র ! গরম এবং ঠান্ডা, সুখ এবং দুঃখ সাময়িকভাবে আসে এবং চলে যায়।  হে ভারত ! ইন্দ্রিয়ের অনুভূতির প্রভাবে তা উৎপন্ন হয়।  তাই তোমার কর্তব্য হচ্ছে, বিচলিত না হয়ে সেইগুলি সহ্য করার অভ্যাস করা। ”


আমেরিকায় কখনও কখনও খুব বেশি ঠান্ডা পড়ার ফলে সকালবেলায় জলে স্নান করা অত্যন্ত কষ্টসাপেক্ষ হয়ে ওঠে।  কিন্তু তার অর্থ কি এই যে, ভক্তরা প্রাতঃ স্নান করা বন্ধ করে দেবে ? না।  ঠান্ডা পড়া সত্ত্বেও তাদের নিয়মিত স্নান করতে হবে।  কর্তব্য তো পালন করতেই হবে, তাতে একটু অসুবিধা হলেও তা করতেই হবে।  একে বলা হয় তপস্যা। ‘তপস্যা’ শব্দটির যথার্থ অর্থ হচ্ছে– এই জগতে বিপত্তি এবং সংকটের দ্বারা বিপর্যয় হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণভাবনাময় কার্যে যুক্ত থাকা– অর্থাৎ, জীবনের দুঃখ-দুর্দশাগুলি স্বেচ্ছায় স্বীকার করে নেয়া।


কখনও কখনও কঠিন তপস্যারত মানুষ গ্রীষ্মকালের প্রচন্ড গরমে তার চারপাশে বৃত্তাকারে আগুন জ্বালিয়ে বসে ধ্যান করে।  তেমন, আবার কেউ কেউ প্রচন্ড শীতে জলে দাঁড়িয়ে ধ্যান করেন।  তপস্যার কঠোর পদ্ধতিতে এই ধরনের ব্রত পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।


কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আমাদের এই রকম কোন আদেশ দেননি।  পক্ষান্তরে, তিনি এক অত্যন্ত সুন্দর কার্যক্রম দিয়ে গেছেন– গান গাও, নাচো এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদিত প্রসাদ গ্রহণ কর।  কিন্তু তবুও এই অতি সহজ পন্থা আমরা গ্রহণ করতে চাই না।  আমরা এতই অধঃপতিত যে, এইটুকু তপস্যাও আমরা স্বীকার করতে পারি না।  যদিও এই ধরনের তপস্যা করা অত্যন্ত সরল এবং অত্যন্ত সুখাবহ (সুসুখং কর্তুমব্যয়ম্), তবুও আমরা তা পালন করতে নারাজ।  কিছু মানুষ মদ্যপান করা, কাম-বাসনা চরিতার্থ করা এবং রাস্তায় পড়ে থাকাটা অধিক পছন্দ করে।  সুতরাং তাদের নিয়ে আর কি করা যাবে ?


অতি দূর এবং অতি নিকট

কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন সব রকম সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, যাতে মানুষ তাতে যোগ দিতে পারে, সংকীর্তন এবং নৃত্য করতে পারে, অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে, কৃষ্ণপ্রসাদ গ্রহণ করতে এবং সুখী হতে পারে– কিন্তু তবুও মানুষ তা গ্রহণ করতে চায় না।  একেই বলা হয় দুর্ভাগ্য।  তাই এই যুগের মানুষের অবস্থা বর্ণনা করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন, “আমি এমনই দুর্ভাগা যে ‘হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র’ উচ্চারণের প্রতি আমার কোনই আসক্তি নেই।” তিনি প্রার্থনা করে বলেছেন–

নাম্নামকারি বহুধা নিজসর্বশক্তি-

স্তত্রার্পিতা নিয়মিতঃ স্মরণে ন কালঃ।

এতাদৃশী তব কৃপা ভগবন্মমাপি

দুর্দৈবমীদৃশমিহাজনি নানুরাগঃ ॥

ভগবানের দিব্য পবিত্র নামে ভগবান তাঁর সমস্ত শক্তি অর্পণ করেছেন।  শ্রীকৃষ্ণের শক্তি অনন্ত এবং তাঁর নামে সেই অনন্ত শক্তি রয়েছে।  শ্রীকৃষ্ণের নাম অসংখ্য, এবং তার মধ্যে কৃষ্ণনাম হচ্ছে মুখ্য এবং তা জপ করার জন্য কোন কঠোর নিয়ম নেই।  এমন নয় যে, মানুষকে কোন বিশেষ সময়ে, বিশেষ অবস্থায় জপ করতে হবে। না– সে যে কোন সময়ে, যে কোন অবস্থায় ভগবানের নাম জপ করতে পারে।  আর তা ছাড়া, শ্রীকৃষ্ণের নাম স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণেরই সমান।  তাই শ্রীকৃষ্ণের পবিত্র নাম শ্রীকৃষ্ণ থেকে অভিন্ন।  ভগবানের এই নাম উচ্চারণ করার ফলে ভগবানের সঙ্গলাভ করা যায়, কিন্তু আমাদের এমনই দুর্ভাগ্য যে, সেই নাম উচ্চারণের প্রতি আমাদের কোন আসক্তি নেই।


আমাদের মনে করা উচিত নয় যে, শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ধাম গোলোক বৃন্দাবনে রয়েছেন এবং সেখানে না গেলে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে না।  রীকৃষ্ণের নাম শ্রীকৃষ্ণ থেকে অভিন্ন।  জড় বস্তু অবশ্য তাঁর নাম থেকে ভিন্ন। কিন্তু পরা প্রকৃতিতে এই ধরনের কোন ভিন্নতা নেই।  শ্রীকৃষ্ণের নাম তাঁরই মতো সর্বশক্তিমান।  আমাদের জিহ্বায় আমরা যদি এই হরেকৃষ্ণ নাম জপ করি, তা হলে তৎক্ষণাৎ আমরা শ্রীকৃষ্ণের সান্নিধ্য লাভ করব, কেননা নাম শ্রীকৃষ্ণ এবং ব্যক্তি শ্রীকৃষ্ণ ভিন্ন নন।  আমরা মনে করতে পারি যে, শ্রীকৃষ্ণ আমাদের থেকে বহু দূরে রয়েছেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শ্রীকৃষ্ণ আমাদের হৃদয়ে রয়েছেন।  তিনি আমাদের থেকে অনেক দূরে রয়েছেন, আবার সেই সঙ্গে তিনি আমাদের অত্যন্ত নিকটেও রয়েছেন। আর আমরা যদি মনে করি যে, শ্রীকৃষ্ণ বহু দূরে রয়েছেন, তবুও তাঁর নাম আমাদের কাছে রয়েছে।  আমরা ‘হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র’ জপ করতে পারি এবং তৎক্ষণাৎ আমরা শ্রীকৃষ্ণের সান্নিধ্য লাভ করতে পারি।  এই অতি সরল উপায়ে আমরা শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করতে পারি, সেই জন্য কোন কঠোর নিয়মের বাধ্যবাধকতা নেই।  আমরা যে কোন সময় শ্রীকৃষ্ণের নাম জপ করে  তাঁকে  পেতে  পারি।  এমনই  হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের  অহৈতুকী  কৃপা।  তাই  শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন–

এতাদৃশী তব কৃপা ভগবন্মমাপি

দুদৈবমীদৃশমিহাজনি নানুরাগঃ।

“হে ভগবান, আপনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার জন্য আপনি আমাকে এতই করুনা করেছেন, কিন্তু আমি এমন ভাগ্যহীন যে, আপনার সেই নামের প্রতি আমার কোন অনুরাগ নেই। আমার অনুরাগ অন্য বিষয়ের প্রতি, কিন্তু কৃষ্ণনাম জপ করার প্রতি আমার কোন অনুরাগ নেই।  এমনই হচ্ছে আমার দুর্ভাগ্য। ” শ্রীকৃষ্ণ এতই উদার যে, তাঁর নামের দিব্য ধ্বনি দ্বারা তিনি আমাদের সামনে উপস্থিত রয়েছেন, যাঁর মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত শক্তি রয়েছে।  আর যদি আমরা সেই নামের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি, তবে আমরা শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত আশীর্বাদ লাভ করতে পারি।  কিন্তু তবুও শ্রীকৃষ্ণের নাম জপ করার প্রতি আমাদের কোন আসক্তি নেই।  এটিই হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য।


সংকট বরণ

ভক্ত কোন রকম সংকট বা বিপত্তিতে বিচলিত হন না।  পক্ষান্তরে, তিনি তা বরণ করে নেন।  সমর্পিত আত্মা হওয়ার ফলে তিনি জানেন যে, সংকট এবং উৎসব, দুঃখ এবং সুখ, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আশীর্বাদ স্বরূপ। বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, ধর্ম এবং অধর্ম, যা হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে বিপরীত, তা শ্রীভগবানের অগ্রভাগ এবং পশ্চাদ্ ভাগ।  তা হলে কি ভগবানের অগ্রভাগ এবং পশ্চাদ্ ভাগের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই ? ভগবান পূর্ণ।  অতএব ভক্ত ঐশ্বর্যের মধ্যেই থাকুক অথবা সংকটের মধ্যেই থাকুক, তিনি সব সময়ই অবিচলিত থাকেন, কারণ তিনি জানেন যে, উভয়েই শ্রীকৃষ্ণ।


ভক্ত যখন সংকটের মধ্যে থাকেন, তখন তিনি মনে করেন, “এখন শ্রীকৃষ্ণ আমার সম্মুখে সংকটরূপে প্রকট হয়েছেন। ” ভগবান নৃসিংহদেব যখন হিরণ্যকশিপুকে সংহার করার জন্য আবির্ভূত হন, তখন তাঁর সেই রূপ ছিল অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, কিন্তু প্রহ্লাদ মহারাজের কাছে তিনি পরম মঙ্গলময়রূপে প্রতিভাত হয়েছিলেন।  ভক্তের কাছে ভগবান কখনই ভয়ানক নন, এবং ভক্ত কোন রকম সঙ্কটেই ভীত হন না, কারন তিনি জানেন যে, সংকট কেবল ভগবানের অন্য একটি রূপ।  ভক্ত মনে করেন, “আমি কেন ভয় পাব ? আমি তো তাঁর শরণাগত। ”

তাই কুন্তীদেবী বলেছেন, বিপদঃ সন্তু– “বিপদ আসুক। ” বিপদঃ সন্তু তাঃ শশ্বৎ– “এই সমস্ত বিপদ বারংবার আসুক।” তিনি জানতেন, সংকটের সময় শ্রীকৃষ্ণকে কিভাবে স্মরণ করতে হয়, অতএব তিনি সংকট স্বীকার করে নিয়েছিলেন।  তিনি বলেছেন, “আমার প্রিয় ভগবান, আমি সমস্ত সংকটকে স্বাগত জানাই, কেননা যখন সংকট আসে, তখন আমি তোমাকে স্মরণ করতে পারি। ” প্রহ্লাদ মহারাজের পিতা হিরণ্যকশিপু যখন তাঁকে সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে ফেলেছিলেন, তখন প্রহ্লাদ মহারাজ কেবল শ্রীকৃষ্ণেরই স্মরণ করছিলেন।


অতএব যদি আমাদের সংকটপূর্ণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় এবং সেই সংকট যদি আমাদের শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করতে প্রেরণা দেয়, তবে তা মঙ্গলজনক । “আহা! এখন আমি শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করার সুযোগ পেয়েছি। ” কেন তাকে মঙ্গলজনক বলা হচ্ছে ? তার কারণ হচ্ছে, শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করার ফলে আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতি হয়, তার ফলে আমাদের আর সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে থাকতে হয় না।  ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জুন।  কেউ যদি কৃষ্ণভাবনায় উন্নতি লাভ করেন, তখন তাঁর পরিণামস্বরূপ তাঁকে এই শরীর ত্যাগ করার পর এই জড় জগতে পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না।  এই ইচ্ছাই পোষণ করা উচিত।


বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি যদি খুব সুখে থাকি, তা হলে আমার শরীর সুখী হতে পারে।  কিন্তু এক সময় আমার মৃত্যু হবে এবং তারপর পুনর্জন্ম হবে।  আমার এই শরীরটি ত্যাগ করার পর যদি আমাকে একটি কুকুর অথবা বেড়ালের শরীর গ্রহণ করতে হয়, তা হলে আমার এই সুখদায়ক পরিস্থিতির কি মূল্য আছে ? মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এবং মৃত্যুর পর আরেকটি শরীর ধারণ করতেই হবে।  সেই শরীরটি যে কি শরীর হবে, সেই সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না।  তবে বৈদিক শাস্ত্রের মাধ্যমে আমরা তা জানতে পারি।  শাস্ত্র বলছে যে, আমাদের বিশেষ মনোবৃত্তি অনুসারে আমাদের এক বিশেষ শরীর লাভ হবে।  এই জীবনে আমরা অত্যন্ত সুখপূর্ণ পরিস্থিতিতে থাকতে পারি, কিন্তু যদি আমাদের মনোবৃত্তি একটি কুকুরের মতো হয়, তা হলে পরের জন্মে আমাকে একটি কুকুর হয়ে জন্মগ্রহণ করতে হবে।


সুখলাভের উপায়

তাই, এই সুখাবহ পরিস্থিতির কি মূল্য আছে ? আমি কুড়ি বছর, ত্রিশ বছর, পঞ্চাশ বছর, বড় জোর একশ’ বছর পর্যন্ত কোন সুখপূর্ণ পরিস্থিতিতে থাকতে পারি।  কিন্তু যদি এই দেহ ত্যাগ করার পর আমার মনোবৃত্তি আমাকে একটি বেড়াল, কুকুর অথবা ইঁদুরে পরিণত করে, তা হলে এই সুখপূর্ণ পরিস্থিতির কি লাভ ? কিন্তু মানুষেরা সেই সম্বন্ধে মাথা ঘামায় না।  বিশেষ করে এই যুগে, তারা মনে করে, “আমি খুব সুখে আছি। আমার কাছে অনেক টাকা রয়েছে এবং সুন্দর বাড়ি রয়েছে।  এই শরীরটা যখন শেষে হয়ে যাবে, তখন তো আর আমাকে জন্মগ্রহণ করতে হবে না।  তাই যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন সুখভোগ করে নিই। ” এটিই হচ্ছে সুখবাদের আধুনিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে তা হয় না।


কুন্তীদেবী জন্ম ও মৃত্যু সম্বন্ধে জানতেন, এবং তিনি চেয়েছিলেন যে, তাঁকে যেন বার বার এই আবর্তে পতিত না হতে হয়।  অপুনর্ভবদর্শনম্– এই শব্দটি তা সূচিত করে।  যদি কেউ সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করেন, তবে তিনি কৃষ্ণভাবনামৃতে মগ্ন, কারণ কৃষ্ণভাবনামৃতের অর্থ হচ্ছে সর্বক্ষণ শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করা।  মানুষের চেতনা কৃষ্ণ-বিষয়ক চিন্তায় মগ্ন থাকা উচিত।


তাই, সদ্গুরু তাঁর শিষ্যদের কৃষ্ণভাবনাময় সেবাকার্যে যুক্ত করেন।  যেমন, আমার নির্দেশে আমার শিষ্যরা কৃষ্ণভাবনাময় গ্রন্থ বিতরণ করছে।  কিন্তু কেউ যদি মনে করে যে, গ্রন্থ বিতরণে যে শক্তিক্ষয় হচ্ছে, তা যদি রত্ন বিক্রির কাজে নিয়োগ করা যায়, তা হলে অনেক লাভ হবে, তা হলে সেটি উত্তম বিচার নয়।  তা হলে সে-একটি জহুরী ছাড়া কিছু হবে না।  আমাদের সব সময় অত্যন্ত সচেতন থাকতে হবে, যাতে আমাদের চেতনা কৃষ্ণভাবনামৃত থেকে বিক্ষপ্ত না হয়।


কষ্টের লাঘব

কৃষ্ণভাবনামৃততে সংকট অথবা দুঃখ-দুর্দশা এলেও সেইগুলি আমাদের সহ্য করা উচিত।  প্রকৃতপক্ষে, আমাদের সেই সমস্ত সংকটগুলিকে স্বাগত জানানো উচিত, এবং আমাদের শ্রীকৃষ্ণের মহিমা কীর্তন করে তাঁর কাছে প্রার্থনা করা উচিত।


আমাদের কি রকম প্রার্থনা করা উচিত ? তত্তেহনুকম্পাং সুসমীক্ষ্যমাণো– “হে আমার প্রাণপ্রিয় ভগবান! এটি আপনার মহান কৃপা যে, আপনি আমাকে এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে ফেলেছেন। ” এটিই হচ্ছে ভক্তের দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি সংকটকে সংকট বলে মনে করেন না।  পক্ষান্তরে, তিনি মনে করেন, “এটি হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের কৃপা। ” কি ধরনের কৃপা ? ভুঞ্জান এবাত্মকৃতং বিপাকম্– “আমার পূর্বকর্মের ফলে আমার অনেক বেশি কষ্ট ভোগ করার ছিল।  কিন্তু আপনি সেই কষ্ট লাঘব করে দিয়েছেন এবং আমাকে এখন অত্যন্ত অল্প কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। ” অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় ভক্তকে কেবল নামমাত্র দন্ডভোগ করতে হয়।


বিচারালয়ে অনেক সময় কোন মহত্ত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে অপরাধী রূপে উপস্থিত হতে হয় এবং বিচারক ইচ্ছা করলে তাকে এক লক্ষ টাকা দন্ড দিতে পারেন এবং তিনি জানেন যে, সেই মানুষটির সেই দন্ড ভোগ করার সামর্থ রয়েছে, তবুও তিনি তাকে এক পয়সা জরিমানা দেওয়ার দন্ড দেন।  এটিও দন্ড, তবে তা খুব লাঘব করে দেওয়া হয়েছে।  তেমনই, আমাদের পূর্বকৃত কর্মের ফলস্বরূপ দুঃখ ভোগ করতে হয়।  এটি সত্য এবং তা থেকে আমরা রেহাই পেতে পারি না।  কিন্তু, কর্মাণি নির্দহতি কিন্তু চ ভক্তিভাজান্ কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত ভক্তকে অত্যন্ত অল্প দুঃখ ভোগ করতে হয়।


উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কর্মের ফল অনুসারে কারোর খুন হওয়ার কথা, কিন্তু খুন হওয়ার পরিবর্তে তার পায়ে একটু আঘাত লাগতে পারে।  এইভাবে ভক্তিযুক্ত মানুষদের পূর্বজন্মের কর্মফল অত্যন্ত লাঘব হয়ে যায়।  ভগবান তাঁর ভক্তকে আশ্বাস দিচ্ছেন– অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ– “আমি তোমাকে তোমার সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব।” অতএব যদি কোন ভক্তের পূর্ব ইতিহাস অত্যন্ত কষ্টপূর্ণ অপরাধযুক্ত কার্যে পরিপূর্ণ থাকে, তবুও মৃত্যুর পরিবর্তে তাকে হয়ত পায়ে একটু আঘাত পেতে হয়, এবং তার ফলে পূর্বকৃত পাপকর্মের স্খলন হয়ে যায়।  ভক্ত তা হলে সংকটে ভয় পাবে কেন ?


আমাদের কেবল কৃষ্ণভাবনামৃতের উপর নির্ভর করতে হবে, কেননা যদি আমরা সমস্ত পরিস্থিতিতেই কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হতে পারি, তা হলে আমাদের এই ভৌত জগতে আর বারবার ফিরে আসতে হবে না (অপনুর্ভব-দর্শনম্)।  যদি আমরা নিরন্তর শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ে চিন্তা করতে পারি, শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করতে পারি, শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ে গ্রন্থ পাঠ করতে পারি, এবং কোন-না-কোনভাবে কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত হতে পারি, তা হলে আমাদের এই লাভ হবে যে, আর আমাদের এই ভৌত সংসারে পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হবে না।  এটিই হচ্ছে যথার্থ লাভ।


কিন্তু যদি আমরা অন্য কোন ভৌত কার্যে যুক্ত হয়ে জাগতিক সুখভোগের প্রচেষ্টায় লিপ্ত হই এবং শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে যাই, তা হলে আমাদের পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হবে, তা হলে তাতে কি লাভ ? এই বিষয়ে আমাদের অত্যন্ত সাবধান হতে হবে।  আমাদের এই ধরনের কার্য করা উচিত, যাতে কোন অবস্থাতেই আমরা কৃষ্ণভাবনামৃত থেকে বিচ্যুত না হই, তাতে যত দুঃখ-দুর্দশাই আসুক না কেন।  এটি হচ্ছে কুন্তীদেবীর উপদেশ।


উপরিউক্ত শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে জয়লাভ করার পূর্বে পান্ডবদের অনেক দুঃখ-দুর্দশা সহ্য করতে হয়েছিল।  তাঁদের বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল, তাঁদের জতুগৃহে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছিল, এবং তাঁদের ভয়ঙ্কর সমস্ত নরখাদক রাক্ষসদের সম্মখীন হতে হয়েছিল।  তাঁরা রাজ্যচ্যুত হয়েছিলেন, তাঁদের পত্নীকে হারিয়েছিলেন, প্রতিষ্ঠা হারিয়েছিলেন এবং অবশেষে তাঁদের বনে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল।


আমাদের দৃঢ় শ্রদ্ধাযুক্ত হওয়া উচিত

পান্ডবেরা যখন মৃত্যুপথযাত্রী পিতামহ ভীষ্মের কাছে আসেন, তখন ভীষ্মদেব অশ্রুবর্ষণ করে বলতে থাকেন, “আমার এই সমস্ত পৌত্ররা অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ; এরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ।  কিন্তু তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরই হচ্ছে সব চাইতে ধার্মিক।  তাই তাকে ধর্মরাজও বলা হয়।  ভীম এবং অর্জুন দুজনেই ভক্ত এবং তারা এতই শক্তিশালী বীর যে, তারা একাই সহস্র শত্রুকে হত্যা করতে পারে।  তাদের পত্নী দ্রোপদী সাক্ষাৎ লক্ষ্মী এবং বলা হয়েছে যে, সে যেখানেই থাকবে, সেখানে কোন রকম অন্নাভাব হবে না।  এই রকমই তাদের অদ্ভুত গুণাবলী, আর তদুপরি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তাদের সঙ্গে রয়েছেন।  কিন্তু তবুও তাদের কত কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। ” এই কথা বলতে বলতে তিনি আকুলভাবে ক্রন্দন করতে থাকেন, “আমি জানি না শ্রীকৃষ্ণের কি অদ্ভুত ব্যবস্থা, কেননা এই রকম পবিত্র ভক্তদেরও দুঃখভোগ করতে হয় !”


সুতরাং আমাদের মনে করা উচিত নয় যে, “যেহেতু আমি ভগবানের ভক্ত হয়েছি, তাই আমাকে আর কোন রকম সংকট অথবা দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হতে হবে না। ” প্রহ্লাদ মহারাজকে অত্যন্ত দুঃখভোগ করতে হয়েছিল, এবং তেমনই পান্ডবদের এবং হরিদাস ঠাকুরকেও এবং অন্যান্য বহু ভক্তদেরও নানা রকম দুঃখ-দুর্দশা ভোগ করতে হয়েছিল।  তবে এই ধরনের দুর্দশায় আমাদের চিন্তান্বিত হওয়া উচিত নয়, বা শোকগ্রস্ত হওয়া উচিত নয়।  আমাদের কেবল দৃঢ় শ্রদ্ধা, বিশ্বাস সহকারে ভক্তির পথে এগিয়ে চলা উচিত, এবং আমাদের এই জ্ঞান থাকা উচিত, “শ্রীকৃষ্ণ রয়েছেন এবং তিনিই আমাকে রক্ষা করবেন। ” শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া অন্য কোন আশ্রয় বা অন্য কিছুর প্রয়াস করা উচিত নয়।  সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণের আশ্রয় গ্রহণ করা উচিত, সেটিই হচ্ছে আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন