গৌরহরির আবির্ভাব লীলা

 

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অবতীর্ণ হয়েছিলেন আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে, মহাপ্রভুর আবির্ভাবের তেরো মাস-আগে মাঘমাসে মহাপ্রভুর মা-বাবা শচীদেবী ও জগন্নাথ মিশ্র দেখলেন শ্রী অনন্তদেব তাঁদের ঘরের ভেতরে বিরাজ করছেন। তাঁর হাজার হাজার মুখে দিব্য বেদস্তুতি প্রকাশ করছেন। তিনি হাজার মুখে একই সঙ্গে সমস্ত বেদ মন্ত্র পাঠ করছিলেন।

ভগবান এখানে অবতীর্ণ হবেন এই জন্যে অনন্তদেব এই স্থান এভাবে পবিত্র করতে লাগলেন। ভগবান যখন অবর্তীণ হলেন তখন তিনিও উপস্থিত ছিলেন। জগন্নাথ মিশ্রের শরীর জ্যোতির্ময় হয়েছিল। সেই জ্যোতিতে ঘর দুয়ার ভরে গেল। জ্যোতির্ময় হওয়ার কারণটি হল জগন্নাথমিশ্রের হৃদয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভু বিরাজ করছিলেন।

সদা হৃদয় কন্দরে স্ফরতু বঃ শচীনন্দনঃ।

জগন্নাথমিশ্রের হৃদয়ে শচীনন্দ গৌরহরি বিরাজ করছেন। সেই জন্য তাঁর শরীর থেকে দিব্য জ্যোতি প্রকাশিত হচ্ছিল। সেই সময়টিতে জগন্নাথ মিশ্র শয়নকালে দিব্য স্বপ্ন দেখলেন, বৈকুন্ঠ-ধাম এসে তাঁর হৃদয়ে প্রবেশ করল। তারপর দেখলেন সেই ধাম তাঁর হৃদয় থেকে শচীদেবীর হৃদয়ে স্থানান্তরিত হল।

বেদশাস্ত্র বলে তমো রজো ও সত্ত্ব গুণের উর্ধ্বে শুদ্ধ সত্ত্ব স্তর। যে ব্যক্তি এই স্তরে উন্নীত হয়েছেন, তাঁকে বলা হয় বসুদেব। বসুদেবস্তরের ব্যক্তির হৃদয়ে ভগবান আবির্ভূত হন। সেই রকম শুদ্ধ অবস্থা না হলে ভগবান সেখানে আবির্ভূত হবেন না।

আমাদের হৃদয়ে ভগবানকে আনতে হলে আগে আমাদের হৃদয়েকে পরিস্কার করতে হবে। ভগবানের নাম গ্রহণ, ভগবানের সেবা, ভগবানের সাধনা দ্বারা চেষ্টা করব আমাদের হৃদয়কে শুদ্ধ করে তুলতে যাতে ভগবান আমাদের হৃদয়ে আসতে পারেন। জগন্নাথমিশ্র ও শচীমাতা আমাদের মতো বদ্ধ জীব নন। তাঁরা নিত্য সিদ্ধ ভক্ত। জগন্নাথ মিশ্র বসুদেবের অভিন্ন স্বরূপ। তাঁর হৃদয় শুদ্ধ। শচীদেবীও তাই। আমরা চাই আমাদের হৃদয়ে ভগবান অধিষ্ঠিত হোন, তাই আমাদের চেতনা শুদ্ধ করতে হবে। হরিনামের দ্বারা চেতনা মার্জিত ও শুদ্ধ হয়। শুদ্ধ হলে তখন ভগবানের উপস্থিতি অনুভব করতে পারব। জগন্নাথ মিশ্র সাধারণ জীব নন। তিনি গোলোক বৃন্দাবন থেকে নেমে এসেছেন। কৃষ্ণলীলার অধিকাংশ ভক্তই গৌরলীলায় অংশগ্রহণ করেছেন। আমরা বদ্ধ জীবেরাও ভগবানের নিত্যলীলায় যুক্ত হতে পারি, যদি আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে হরিনাম করি, ভগবানের সেবা করি, যদি ঐকান্তিকভাবে আকাক্সক্ষা করি ভগবানের নিত্য লীলায় যুক্ত হব। ভগবানের বিশেষ কৃপা লাভ করতে পারলে আমাদের হৃদয়ে ভগবান অধিষ্ঠিত হবেন।

কৃপাসিদ্ধ, সাধনসিদ্ধ ও নিত্যসিদ্ধ– এই তিন ধরনের ভক্ত আছেন। যাঁরা গোলোক ধাম থেকে এই জগতে লীলা করতে এসেছেন তাঁরা নিত্যসিদ্ধ। সাধনা ছাড়াও ভগবানের বিশেষ কৃপা প্রাপ্ত হয়ে সিদ্ধ হয়েছেন এমন ভক্ত কৃপাসিদ্ধ। আর যাঁরা ভগবদ্ পাদপদ্ম লাভের জন্য সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করেছেন, তাঁরা সাধনসিদ্ধ। কে কি ধরনের সিদ্ধ ব্যক্তি হয়েছেন তাতে কোন যায় আসে না। যদি আমরা পরম সিদ্ধি লাভের জন্য ঐকান্তিক হই, তবে এই জীবনের অন্তিমে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় সেই ব্রহ্মান্ডের মধ্যে যেখানে গৌরলীলা চলছে। সেখানে আমরা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মহাকীর্তন দলের মধ্যে আমরা যুক্ত হতে পারব কিংবা অন্য কোন বিশেষ সেবা আমরা পেতে পারব। এই হচ্ছে ভক্তি জগতের সাধারণ নিয়ম। এই পৃথিবী থেকে সরাসরি গোলোক বৃন্দাবনে না গিয়ে সাধারণত যে ব্রহ্মান্ডে কৃষ্ণলীলা চলছে কিংবা গৌরলীলা চলছে সেই ব্রহ্মান্ডে গিয়ে সেই লীলায় আমরা অংশগ্রহণ করতে পারব। তারপরে সেখানে আমরা সম্পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ হয়ে গোলোকে উপনীত হতে পারব।

পরদিন জগন্নাথ মিশ্র দিব্য স্বপ্নের কথা শচীদেবীকে বললে শচীদেবীও জানালেন, ‘আমি স্বপ্ন দেখলাম, আপনার হৃদয় থেকে দিব্য জ্যোতির্ময় একটি ধাম আমার হৃদয়ে প্রবেশ করল। আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম দেবতারা আমার দিকে তাকিয়ে কি সব স্তব-স্তুতিও প্রার্থনা করছে।’

এই জগতে লোকে ধর্মাচার করছে নিজের কিছু জড়জাগতিকে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করবার উদ্দেশ্যে। ভগবানের সন্তোষ বিধানের জন্য কেউ কিছু করছে না। ভক্তদের পক্ষে এরকম পরিস্থিতি বিপজ্জনক। দেবতারা ভগবানের উদ্দেশ্যে পার্থনা করতে লাগলেন যে, স্বর্গের দেবতা হয়েও তাঁরা অনেক বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছেন। প্রথমত, পৃথিবীর তুলনায় সেখানে অনেক বেশী সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে বহুকাল সুখভোগ করার ফলে ভগবানকে বিস্মৃত হয়েই থাকা হয়। দ্বিতীয়ত, দৈত্য দানবেরা প্রায়ই স্বর্গলোক আক্রমণ করে থাকে এবং দেবতাদের উৎপীড়ন করতে থাকে। তৃতীয়ত, স্বর্গলোক থেকে সহজে ভগবৎপ্রেম লাভ করে জড়জগতের অতীত বৈকুন্ঠ গোলোকে যাওয়া যায় না। ভগবান স্বয়ং গোলকের প্রেম দান করবার জন্য পৃথিবীতে এসেছেন। সেই প্রেম পৃথিবীর অধিবাসীরা লাভ করতে পারবে, স্বর্গের দেবতা হয়ে লাভ কি! তাই প্রেম থেকে যাতে বঞ্চিত না হওয়া যায় সেজন্য দেবতারাও মহাপ্রভুর অবতরণ কালে পৃথিবীতে মানুষ্যগৃহে জন্মগ্রহণ করবার বাসনা করলেন।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যেদিন জন্মলীলা প্রকাশ করলেন সেদিন ছিল চন্দ্রগ্রহণ। সারা নবদ্বীপ নগরের লক্ষ লক্ষ লোক গঙ্গার জলে নেমেছিলেন। চন্দ্রগ্রহণ সময়টি অপবিত্র সময়, তাই সেই সময়ে শাস্ত্রবিধি হচ্ছে গঙ্গার জলে নেমে স্নান করা। সেই লক্ষ লক্ষ লোক সবাই উচ্চ কলরোলে হরিধ্বনি তুলতে লাগল।

তখনকার ব্রাহ্মণরা বলতেন হরিনাম জোরে করা যায় না। হরিনাম মনে মনে করতে হয়। সবার সম্মুখে যদি হারনাম করা হয় তবে অপরাধ হবে, নামের শক্তি হ্রাস পাবে, হিন্দু সমাজে অমঙ্গল হবে, বিভিন্ন অসুবিধা আছে। কিন্তু গঙ্গা ক্ষেত্র পবিত্র বলে সেখানে হরিনাম উচ্চস্বরে করলে বাধা নেই। শ্রীবাস ঠাকুর ভাবলেন যে, সবাই বলে চন্দ্রগ্রহণ অশুভ, কিন্তু আমি তো শুনছি সবাই হরিনাম করছে অতএব এটাই শুভ মুহূর্ত। সারা নগরের লোক জলের মধ্যে– সবার মুখে হরিধ্বনি। শ্রীবাস ঠাকুর বলছেন এরকম মুহূর্ত যেন প্রতিদিনই থাকে। প্রতিদিনই লোক হরিনাম করুক। তা হলে জগতের মঙ্গল হবে।

পূর্ণিমার সন্ধ্যাকালে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শচীমাতার কোলে জন্মগ্রহণ করলেন। প্রতিবেশীরা সেখানে আসতে লাগল, দেবদেবীগণও অলক্ষিতে আসতে লাগলেন মহাপ্রভুর অঙ্গকান্তি দর্শনে। দেবদেবীরা ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণীরূপে আসতে লাগলেন।

জগন্নাথমিশ্র অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। তিনি ছিলেন দরিদ্র। কিন্তু মনে মনে জগৎবাসীকে বিপুল পরিমাণে সম্পদ দান করতে লাগলেন। পরদিন অদ্বৈত আচার্যের পত্নী সীতা ঠাকুরাণী ওষধী, অলঙ্কার, পোশাক ইত্যাদি নিয়ে এলেন শিশু এবং তার মা-বাবার জন্য। তিনি এসে ভালভাবেই লক্ষ্য করলেন এই শিশু চৈতন্য মহাপ্রভুর চেহারাটির হুবহু গোকুলের কৃষ্ণের মতোই। গায়ের বর্ণ ছাড়া আর কোনও পার্থক্য নেই। কৃষ্ণের অঙ্গবর্ণ শ্যাম আর এই শিশুটি গৌরবর্ণ। গৌর অঙ্গ।

কৃষ্ণ এত কৃপালু এই কলিযুগে গৌরাঙ্গ এসেছেন বদ্ধর জীবনকে উদ্ধার করবার জন্য। আমাদের জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। আমরা সুযোগ পেয়েছি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর হরিনাম সংকীর্তন আন্দোলনে আমরা থাকতে পেরেছি। কতজন কত দূর থেকে এখানে মহাপ্রভুর জন্মতিথি উৎসবে যোগ দিতে এসেছেন। মধ্যপ্রাচ্য দেশ থেকে কেউ কেউ এসেছেন যারা অন্যধর্ম-যাজন করেন। সকাল বেলায় পাঁচজন আমার কাছে এসেছিলেন। তাঁদের দেশে কোনও হরেকৃষ্ণ কেন্দ্র গড়ে উঠেনি। তবুও তাঁরা হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করছেন। তাঁরা আনন্দেই রয়েছেন।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এসেছেন কেবল বাঙ্গালীদের বা ভারতীয়দের উদ্ধার করবার জন্যই নয়, সারা বিশ্বকে উদ্ধার করার জন্য। যখন শ্রীল প্রভুপাদকে প্রশ্ন করা হয়েেিছল, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কেবল ভারতে হরেকৃষ্ণ প্রচার করলেন আর বিশ্বের বাদবাকী স্থানগুলিতে প্রচার করেননি কেন? তখন শ্রীল প্রভুপাদ উত্তর দিয়েছিলেন, যে যে স্থানে প্রচার হয়নি সেই সমস্ত স্থানে প্রচারের দায়িত্ব মহপ্রভু আমাদের সবার হাতেই অর্পণ করেছেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন