গৃহস্থদের দায়িত্বশীল হতে হয়

 



শ্রীমদ্ভাগবতের চতুর্থ স্কন্ধের ২৪ অধ্যাযে বর্ণিত কাহিনীতে আমরা দেখি যে, প্রচেতা রাজকুমারেরা ভগবান শিবের দর্শন পাওয়ায় বিদুর আশ্চর্যান্বিত হয়েছেন। কারণ মহাদেব সচরাচর সহজে কাউকে দেখা দেন না।

বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে মহাদেবের অস্তিত্বের মহিমা সবার উপরে, একমাত্র শ্রীবিষ্ণুর পরে। যথার্থ গুরুশিষ্য পরম্বরার ধারায় তিনি একজন বিশিষ্ট বৈষ্ণবও। এই নবদ্বীপেই মহাদেব বিষ্ণুস্বামীকে উপদেশ দেন। এই মায়াপুর নবদ্বীপে শিবের অন্যান্য লীলা আছে। প্রকৃতপক্ষে শিব হলেন ধামাদির রক্ষাকর্তা। শিবের অনুগ্রহ বিনা ধামে প্রবেশ করতে কেউ পারে না।

নবদ্বীপ পরিক্রমায় একাধিক শিব-মাহাত্মের স্থান পাই। সীমন্তদ্বীপে বিভিন্ন মূর্তি আছে। পার্বতীদেবীকে শিব উপদেশ দেন গৌরাঙ্গদেবের আরাধনা করতে, তাঁর দর্শন লাভ করে তাঁর চরণধুলি গ্রহণ করতে। গোদ্রুম, হরিহরণক্ষেত্র, মহৎপুর রুদ্রদ্বীপ, শঙ্করপুর, ঋতুদ্বীপ ইত্যাদি স্থান শিবের নানা লীলাস্থল। একবার ব্রহ্মার বাহনে চড়ে শিব অবতরণ করেন। সেই জায়গায় এখন রাজহংসের পিঠে শিবের মূর্তি পূজা হয়। রুদ্রদ্বীপের শঙ্করপুরে শঙ্করাচার্য এসে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর স্বয়ং সাক্ষাৎ করে দর্শন লাভ করেন এবং মহাপ্রভু তখন তঁকে বলেন যে, এটি আমার ধাম, এখানে সবাই ভগবানের ভক্ত, এখানে কোনও রকমের প্রচার নেই, আপনি অন্যান্য স্থানে প্রচারকার্য করুন।

শঙ্করাচার্য এসেছিলেন আনুমানিক দু’হাজার বছর আগে। তাঁর পরে আসেন বৈষ্ণবাচার্য, তিনি জনসাধারনের মধ্যে ভগবানের ব্যক্তি রূপের আরাধনার প্রচার করেন। এইভাবে চারজন বৈষ্ণব ধারা প্রবর্তক এসেছিলেন– মধ্বাচার্য, রামানুজাচার্য, নিম্বার্কাচার্য এবং বিষ্ণুস্বামী।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এসেছিলেন বৈষ্ণব পরম্পরায় এই চারটি ধারাকেই একত্রিত করতে। কলিযুগে একটাই ধারা থাকবে, শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, বৌদ্ধদের আর মায়াবাদ প্রচার করবার দরকার নেই, সকলেই হয়ে উঠুক সাকারবাদী। বৌদ্ধরা নিশ্চয় জানবেন যে, ভগবান বুদ্ধ নিজেই শ্রীবিষ্ণু। মায়াবাদীদের জানা উচিত যে, স্বয়ং শিব এসেছেন শঙ্করাচার্য রূপে– বিষ্ণুরই আদেশে, বৌদ্ধগণকে বেদ অনুগামী করে তুলতে।

এই হচ্ছে সময় যখন সকলেই শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তিভাবাপন্ন হয়ে উঠবে। এখন মহাপ্রভু আদেশ করলেন, সারা ব্রহ্মান্ডের সমস্ত মানুষ কৃষ্ণভাবনা গ্রহণ করুক, আর বাকি সকলকে তা বিতরণ করুক।

ভগবান শিবকে দর্শনে পাওয়া খুবই দুলর্ভ। শঙ্করাচার্য খুবই সুদর্শন ছিলেন। তেমনই, প্রচারকার্যে আমাদেরও ভগবান শিবের আশীর্বাদ দরকার। পাটনা গয়ায় কৃষ্ণ, বলরাম এবং শিবলিঙ্গের মূর্তি আছে। কথিত আছে যে, গৌর-নিতাই আছেন ঐ কৃষ্ণ-বলরাম রূপে এবং অদ্বৈত আচার্য এসেছেন ঐ শিবলিঙ্গ রূপে। সুতরাং ভক্তগণ সেখানে শিবের আশীর্বাদ এবং কৃষ্ণ-বলরামের কৃপা গ্রহণ করে থাকেন।

বৃন্দাবনের শিব গোপেশ্বরশিব রূপে পূজিত। দক্ষিণ ভারতে প্রচার করার সময়ে সেখানকার ভক্তরা বলে ‘আপনারা কেবলই কৃষ্ণ, বলরাম, রামের কথা বলেন, রুদ্র সম্প্রদায় শিবের কথা বলেন না কেন? কারণ তামিল অঞ্চলে ভগবান শিবের পূজার প্রচলনই বেশি। আমাদের পরম্পরা ধারায় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শিবের প্রতি খুব শ্রদ্ধাবান ছিলেন। তিনি শিব মন্দিরেও যান, যেমন সুন্দরেশ্বর মন্দির দক্ষিণ ভারতে এবং মীনাক্ষি মন্দির এবং সেখানে তিনি কি করেছিলেন– মহাপ্রভু সেখানে ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে/ হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে’ কীর্তন করেছিলেন।

শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, অন্য কোথাও দর্শনের প্রয়োজন নেই। মায়াবাদের কোনও প্রয়োজন নেই। আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের শুরু হয় ভগবদ্গীতা অধ্যয়ন করার পর থেকে এবং গীতার চরম উপদেশ হচ্ছে, পরম পুরুষ ভগবানের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। যদিও লোকে শিবের পূজো করে নানা জাগতিক প্রয়োজনে, সেটা অবশ্যই প্রশংসনীয় তবে শিবের কৃপা হল ভগবদ্ভক্তি লাভের জন্য।

শিব একজন মহান বৈষ্ণব, তিনিই ভগবদ্ভক্তি দান করতে পারেন। ঠিক যেমন গোপীরা আরাধনা করেছিল, তারা জাগতিক কিছু পেতে চায়নি, বরং ত্যাগী হয়ে আরাধনা করেছিল– ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তাদের স্বামীরূপে পেতে।

প্রার্থনা করা উচিত একমাত্র কৃষ্ণভক্তি পাওয়ার জন্য। এতকাল ধরে, জন্ম থেকে লোকে যে পূজা পদ্ধতিতে অভ্যস্ত, তা ত্যাগ করতে বলাটা খুব কঠিন, এটা তাদের জানানো প্রয়োজন– কিভাবে শিব নিজেই বিষ্ণুর কাছে প্রার্থনা নিবেদন করে থাকেন।

এখনি সময় এসেছে সমস্ত বদ্ধ জীবদের মায়াবাদ ধারণা থেকে পরিশুদ্ধ করে, তাদের অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্বে ফিরিয়ে আনার, পরম সত্যের ব্যক্তি-স্বরূপ উপলব্ধির পথে ফিরিয়ে আনার। এর জন্য প্রয়োজন ভগবদ্গীতা যথাযথ-র একনিষ্ঠ অধ্যয়ন এবং জোরদার প্রচার। গীতায় কৃষ্ণ বলেছেন, ‘সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ’। কিছু বিজ্ঞজন তার অনুবাদ করেন যে, কৃষ্ণের মধ্যে যে ‘ছেলে’টি আছে তার প্রতি আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু প্রভুপাদ বলছেন সেটা ভুল। শ্রীকৃষ্ণ ভেতরে বাইরে সবই এক চিন্ময় সচ্চিদানন্দ। এই ভাবেই মানুষ বিভ্রান্ত হয়, তারা ভগবানের ব্যক্তি-স্বরূপটা উপলব্ধি করতে পারে না।

শ্রীকৃষ্ণের ব্যক্তিত্ব বোঝা খুব শক্ত। তিনি যখন বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরা যান, সেখানে কত রকম বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা ছিল, রাজপুত্র যখন হলেন তখন কত প্রকার রাজনৈতিক কুটনৈতিক ব্যাপার সামলাচ্ছেন।

কৃষ্ণ-বলরাম যখন হস্তিনাপুর যান, স্যমন্তক মণি চুরির ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েন। সত্যভামার পিতার মৃত্যুতে সত্যভামা এসে কৃষ্ণের কাছে শোকাহত হয়ে কান্নাকাটি করলে শ্রীকৃষ্ণও তাঁর রাণীর দুঃখে ব্যথিত হন এবং তাঁর চোখেও জল দেখা দেয়। যদিও শ্রীকৃষ্ণ চিন্ময়, এবং জাগতিক লাভ-ক্ষতির সাথে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই, তবুও তাঁর ভক্তদের আবেগ অনুভূতির প্রত্যুত্তরে তিনি খুবই ব্যক্তিগত আচরণ প্রকাশ করতে পারেন। এবং এই রকম পরিস্থিতিরও সৃষ্টি করেন তাঁর লীলা প্রকাশ করার জন্য। এই লীলাশক্তির প্রভাবে আর সকল অংশগ্রহণকারীও এই লীলায় যোগদান করতে পারেন। ঠিক যেমন আমরা নাটক মঞ্চস্থ করে থাকি, ভগবানও তাই করেন– লীলা।

সর্বজ্ঞ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কি জানতেন না যে, স্যমন্তক মণিটা কোথায় ছিল? কিন্তু তিনি আর সকলের মতো সাধারণ ভাবেই খোঁজাখুজির লীলা করে চললেন। এমনকি ঋষিরা পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণের ব্যক্তিত্ব বুঝে উঠতে পারে না। কেবলমাত্র ভক্তরাই বুঝতে পারেন যে, এই সমস্তই তাঁর বিশাল লীলাখেলার অঙ্গ।

স্যমন্তক মণি চুরি যাওয়ার রহস্যে লোকে শ্রীকৃষ্ণের নামেও বাজে গুজব রটনা করেছিল। শ্রীকৃষ্ণ যতদিন এই ধরাধামে ছিলেন, তাঁর লীলাশক্তির প্রভাবে, আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই নানাজনের সমালোচনার পাত্র বনেছিলেন। যদিও স্যমন্তক মণি চুরি বা অধিকারের বিষয়ে কৃষ্ণের কোনও ভূমিকা ছিল না, তবুও লোকে তাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল। তখন তিনি অক্রুরকে ডেকে বলে দেন, উদ্ধার করা মণিটা এখন কার কাছে থাকা উচিত। সত্রাজিৎ যেহেতু মৃত, তাঁর স্ত্রীও মৃত, এবং তাঁদের কোন পুত্রসন্তান নেই, সুতরাং বৈদিক রীতি অনুসারে পরবর্তী উত্তারাধিকারী হচ্ছে কন্যার পুত্রসন্তান, সত্যভামার যে ছেলে জন্মাবে, তার মণিটা নিজে না নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ এই ব্যবস্থা করলেন সকলকে বোঝাতে যে, এই মণির ব্যাপারে তিনি সত্যিই মর্মাহত হয়েছেন।

কৌরব রাজসভাতেও পান্ডবদের ও বিদুরকে নানাভাবে দুর্যোধনের মিথ্যা অপবাদের পাল্লায় পড়তে হয়েছিল। ভক্তদের মাঝেও অনেক সময়ে একজন আর একজনের বিরুদ্ধে কথা বলে থাকে। এটা মোটেও ভাল নয়। এতে ভক্তদের উপর অভিশাপ আসে। কিন্তু তাতে হতাশ হওয়া উচিত নয়। আসলে হতাশ হবার মতো পরিস্থিতিই এটা, তবুও ভগবানের সেবায় যুক্ত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পর্যন্ত নিন্দনীয় অপবাদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ভক্তরা মাঝে মধ্যে এরকম ভাবে যে, কেউ কেউ আমার নামে বলেছে, সুতরাং আমি আর এই সেবা করতে পারব না– এটা মিথ্যা অহমিকা। আমরা বিপদে থাকি অথবা সম্পদে থাকি, বেদনায় থাকি বা সুখে থাকি, ভগবান কৃষ্ণের সেবা থেকে আমরা কখনও চ্যুত যেন না হই।

অনেকে মনে করে, ব্রহ্মচারী বা সন্ন্যাসীদের ভক্তিচর্চায় নানা প্রকার সুবিধা রয়েছে। কিন্তু যে কোনও আশ্রমই হোক, তা সঠিক ভাবে পালন করাটাই সেই আশ্রমের দায়িত্ব।

একবার এক ভক্ত প্রভুপাদের কাছে এসে তার কিছু সমস্যার কথা বলে। প্রভুপাদ পরামর্শ দেন, তুমি গৃহস্থ আশ্রম নিচ্ছ না কেন? ভক্তটি বলে, ‘ না, না, তাহলে আমি অধঃপতিত হয়ে যাব।’ শ্রীল প্রভুপাদ বলেছিলেন, “না, তুমি অধঃপতিত হয়েই গেছ, কারণ ব্রহ্মচর্য আশ্রম সঠিকভাবে পালন করছ না, এবং গার্হস্থ্য আশ্রম নিলে পতিত হবে না। সেটা একটা দায়িত্ব।”

আমরা চাই ব্রহ্মচর্য আশ্রমে যারা থাকবে তারা অবশ্যই সম্পূর্ণ নৈষ্ঠিক হবে। বর্তমান কলিযুগে কামনা বাসনা অত্যন্ত প্রবল। তবে কামনা আসবে আর তাকে দমন করব,  এটাই প্রবণতা হওয়া উচিত নয়। স্ত্রী পুত্র সংসার এগুলি খারাপ নয়। গৃহস্থ হওয়া মানে পতন থেকে উদ্ধারের পথে নামা। তবে তাদের ঐ আশ্রম পালনে অত্যন্ত দায়িত্বশীল হতে হয়।

ভক্তিমূলক সেবাটাই প্রধান কথা, তা সে আশ্রমই হোক। চাই দায়িত্ববান ব্রহ্মচারী, চাই দায়িত্ববান গৃহস্থ, চাই দায়িত্ববান সন্ন্যাসী — দায়িত্বহীনদের আমাদের কোথাও প্রয়োজন নেই। যে ব্রহ্মচারী নিষ্ঠাচার ভঙ্গ করছে, সেটা খুবই নিন্দনীয়, তাকে চাই না, যে গৃহস্থ তার আশ্রম তার পরিবারের দায়িত্ব নেয় না, তাকে চাই না। যে আশ্রমই নিই নিষ্ঠাযুক্ত হতে হবে। পতিত ব্রহ্মচারী হওয়ার চেয়ে দায়িত্বশীল গৃহস্থ হওয়া কত ভাল।

প্রচেতাদের আলাদা আলাদা স্ত্রী থাকবে কারণ সেটা তাদের গুরুর আদেশ ছিল। তারা এমনভাবে গার্হস্থ্য আশ্রম গ্রহণ করতে চায়নি যাতে সেখানে তারা গৃহমেধী হয়ে ওঠে। তাই তারা তপস্যা করে কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করছিল, যাতে যখন গৃহস্থ আশ্রমে প্রবেশ করবে, তখন কঠোর নিষ্ঠাযুক্ত গৃহস্থ হতে পারবে, এবং শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আরাধনার ফলে তারা শ্রীকৃষ্ণকেও সন্তুষ্ট করছিল, শিবও সন্তুষ্ট হচ্ছিলেন।

ব্রহ্মচারী অনেক রকমের আছে– যারা সারা জীবন ব্রহ্মাচারী থাকতে চায় অথবা পরে কোনও এক ধাপে গৃহস্থ হতে চায়। কলিযুগের সমগ্র পরিস্থিতিতে যে কোনও আশ্রম পালনই খুব কঠিন। তাই শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন, কৃষ্ণভক্তি অনুশীলন করতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন