আসুরিক মনোবৃত্তি বিফলে যায়

 ভক্ত প্রহ্লাদ বলেছিলেন ‘শ্রীহরি সর্বত্র বিরাজ করছেন।’ পুত্রের এই কথায় ক্রুদ্ধ পিতা অসুররাজ হিরণ্যকশিপু যখন প্রহ্লাদকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোর শ্রীহরি কি এই স্তম্ভটিতে আছে?’ প্রহ্লাদ নির্ভয়ে উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, শ্রীহরি সর্বত্রই বিরাজ করছেন।”




হিরণ্যকশিপু তখন স্তম্ভটিকে ভেঙে ফেলার জন্য সজোরে আঘাত করলেন। ভক্তের কথার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরি সভাগৃহের সেই স্তম্ভের মধ্য থেকে আবির্ভূত হলেন। তবে শ্রীহরির সেই রূপটি ছিল অদ্ভুত রকমের। সেই রূপটি ছিল না মানুষের, না সিংহের। এভাবে নরসিংহরূপে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন।

ভগবান বলেছেন, ন মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি। ‘আমার ভক্তের কখনও বিনাশ নেই।’ প্রহ্লাদ জানতেন ভগবান শ্রীহরি আমাকে সর্ব অবস্থায় সুরক্ষা করবেন। আমাকে কখনও ক্ষতিগ্রস্থ হতে দেবেন না। যেহেতু প্রহ্লাদ সম্পূর্ণভাবে শ্রীকৃষ্ণের ওপর নির্ভরশীল, তাই শ্রীকৃষ্ণও সম্পূর্ণভবে তাকে সুরক্ষা প্রদান করলেন। হিরণ্যকশিপু বারংবার শিশুপুত্র প্রহ্লাদকে শ্রীহরিনাম কীর্তন করতে নিষেধ করেছিলেন। এমনকি প্রহ্লাদকে হত্যা করবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু প্রহ্লাদের স্থির বিশ্বাস ছিল যে, শ্রীহরির সুরক্ষার ফলে কিছুতেই কেউ তাঁকে বধ করতে পারবে না। হিরণ্যকশিপু স্তম্ভটিকে ভেঙে ফেললেন এবং তিনি জানতেন শ্রীহরি স্তম্ভের ভেতর থেকে আসবে। অতএব তাঁর পুত্রকে আগের থেকেই ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘স্তম্ভের ভেতর যদি তোমার শ্রীহরিকে না দেখতে পাই তবে তোমাকে আমি কেটে ফেলব, দেখি তোমার শ্রীহরি কিভাবে তোমাকে রক্ষা করে।’ নাস্তিক অসুরদের প্রচন্ড ঔদ্ধত্য।

অসুর হিরণ্যকশিপু অত্যন্ত কঠোর তপস্যা করেছিলেন। তাঁর তপস্যায় শ্রীব্রহ্মা তাঁকে বর দিতে চাইলে, তিনি বললেন, কোন পশু, মানুষ, রাক্ষস, দেবতা গন্ধর্ব, তথা ব্রহ্মার সৃষ্টির কোনও জীবের দ্বারা তাঁর মৃত্যু হবে না। আকশে জলে বা মাটিতে তার মৃত্যু হবে না। রাতে বা দিনের বেলায় তার মৃত্যু হবে না। ঘরে বাইরে কিংবা ভেতরে তার মৃত্যু হবে না। কোনও অস্ত্রে বা অভিশাপে বা ব্যাধিতে মৃত্যু হবে না। এ সমস্ত বর তিনি ইতিমধ্যেই ব্রহ্মার কাছে প্রাপ্ত হয়েছেন।

শ্রীব্রহ্মার  সমস্ত রকমের বর লাভ করে হিরণ্যকশিপু নিজেকে স্বাধীন ও স্বরাট্ ও নির্ভীক স্বেচ্ছাচারী বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে স্তম্ভটি থেকে ভয়ংকর গর্জন করতে করতে অদ্ভুতরূপ নৃসিংহদেবকে দর্শণ করে তিনি অবাক হন। তাকে হিরণ্যকশিপু গদার আঘাতে মেরে ফেলতে চাইলেন। কিন্তু সেই রূপ অত্যন্ত ভয়ংকর ছিল।

অসুর হিরণ্যকশিপু বুঝলেন, ব্রহ্মার সমস্ত বর এবার বৃথা হয়ে যাচ্ছে। কেননা, ঐ নরসিংহরূপধারী ব্রহ্মার সৃষ্টির কোন জীব নন। সমস্ত অস্ত্র ছাড়াই লম্বা তীক্ষ্ নখ দ্বারা নিহত হতে হচ্ছে। গোধূলি বেলায়। দিন বা রাত বলা চলে না। ঘরের বাইরে বা ভেতরেও তার মৃত্যু হচ্ছে না– ঠিক ঘরে চৌকাঠের মধ্যে । আকাশে, জলে বা মাটিতে নয়, নরসিংহের জানুর উপরেই মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। এভাবে সমস্ত তপস্যার ফল স্বরূপ তিনি ব্রহ্মার কাছে যা যা বর চেয়েছিলেন সব বরই অনর্থক লাভ করেছিলেন। এভাবে ভয়ংকর উগ্ররূপ নৃসিংহদেবের আবির্ভাব হল।

প্রতাপশালী অসুর হিরণ্যকশিপু স্বর্গ মর্ত্য পাতাল অধিকার করেছিলেন। প্রায় সমস্ত দেবতা তার অধীন দাস হয়ে পড়লেন। হিরণ্যকশিপু সর্বত্র ঘোষণা করলেন, কোথাও বিষ্ণুপূজা চলবে না। একমাত্র পূজা হবে– হিরণ্যকশিপু পূজা। বিষ্ণু তার বড় ভাইকে হত্যা করেছেন। সেইজন্য সমস্ত বৈষ্ণবদের উপর অত্যাচারও শুরু হল। সারা জগতে এখন চলবে কেবল হিরণ্যকশিপু পূজা । অসুররাজ হিরণ্যকশিপুকে পূজা করার জন্য তৈরী হল বিশাল একটি গৃহ, যার দৈর্ঘ্য ছিল একশো যোজন। এক যোজন সমান আট মাইল বা বারো কিলোমিটার। অতএব, পূজাগৃহটি ছিল একহাজার দুশো কিলোমিটার দীর্ঘ। এখান থেকে দিল্লী। প্রায় চৌদ্দশ কিলোমিটার। অতএব সেই পূজার ঘরটি কত বড় ছিল। ঘরের ভেতরেই ছিল গাছপালা, পুকুর সব কিছু। মেঝে ছিল সব দামী পাথরে মোজাইক করা। সেই ঘরটি আয়তনে আমাদের ভারত দেশটির মতো জায়গা জুড়ে। চারশ হাত উচ্চতা যুক্ত একটি গগনচুম্বী বেদীতে হিরণ্যকশিপু বসে থাকতেন। আর সবাই তার জয় ধ্বনি দিয়ে তাঁর পূজা করতে লাগল। অপ্সরা বিদ্যাধর গন্ধর্ব সেই মন্দিরে নৃত্য, গান, বাদ্য বাদন করতে লাগল। সেখানে হিরণ্যকশিপুর প্রভাবে সারা ঘর দুয়ার জ্যোতির্ময় হয়েছিল। প্রাকৃতিক পরিবেশ মনোরম হয়েছিল। কারও রোগ ছিল না। কারও খাদ্যের অভাব ছিল না। ধরিত্রীদেবী ভয়ে অঢেল ফুলফল শস্যে সুসজ্জিতা ছিলেন। সবাই অসুররাজ হিরণ্যকশিপুকে ভগবানজ্ঞানে শ্রদ্ধা ও পূজা নিবেদন করতে লাগলেন।

কিন্তু হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ বললেন, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরির থেকেই এই ক্ষমতা বাবা পেয়েছেন তাই এত প্রভাবশালী হয়েছেন। আদৌ বাবার এক বিন্দুও ক্ষমতা নেই। সমস্ত ঐশ্বর্য সমস্ত শক্তির উৎস একমাত্র শ্রীহরি।

পুত্রের মুখে এরকম কথা শুনে হিরণ্যকশিপু ক্রোধান্বিত হলেন। তিনি বললেন, ‘প্রহ্লাদ, আমিই সর্বেসর্বা। আমার চেয়ে বড় কেউ নেই। এ কথা যদি তুমি স্বীকার না করো তবে তোমাকে আমি মেরে ফেলব। আমি তোমাকে আজ সন্ধ্যাকাল পর্যন্ত সময় দিলাম। এর মধ্যে তুমি যদি আমাকে পরমেশ্বর ভগবানরূপে স্বীকার না করো তবে অবশ্যই আজ তোমাকে হত্যা করব।’

সবাই দেখল আর মোটেই সময় নেই, সন্ধ্যা নেমে আসছে, কিন্তু প্রহ্লাদ কেবল শ্রীহরির নাম করছে। তার পিতা হরিণ্যকশিপুকে ভগবান বলে মানছে না। এমন সময় দেখা গেল সেই মন্দিরের বিশাল তোরণ দ্বার দিয়ে অদ্ভুত নৃসিংহদেব আগমন করছেন। এই অদ্ভুত রূপটি কি? হিরণ্যকশিপুর নির্দেশে তার অনুচরেরা সেই নৃসিংহদেবকে আসতে বাধা দিয়ে, সেখান থেকে চলে যেতে বলল। কিন্তু সব নির্দেশ অগ্রাহ্য করে শ্রীনৃসিংহদেব এগিয়ে আসতে লাগলেন। মায়াবী অসুরেরা স্থানটিকে অন্ধকার করে তুলল যাতে নৃসিংহদেব কিছু না দেখতে পান। কিন্তু নৃসিংহদেবের অঙ্গের জ্যোতিতে কোথাও অন্ধকার থাকল না। তারপর অনুচরেরা বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করল, কিন্তু কোনও অস্ত্রেই নৃসিংহদেবের অঙ্গ স্পর্শই করল না। অনুচরেরা তখন হিরণ্যকশিপুকে পরিস্থিতির কথা জানালে হিরণ্যকশিপু বিভিন্ন অস্ত্র ধারণ করলেন। আগ্নেয়াস্ত্র, বায়ুঅস্ত্র, বরুন অস্ত্র, কঙ্কাল অস্ত্র, নারায়ন অস্ত্র ইত্যাদি যাবতীয় অস্ত্র প্রয়োগ করতে লাগলেন, কিন্তু সমস্ত অস্ত্রই বিফল হল। এবার হিরণ্যকশিপু অস্ত্রহীন হয়ে স্বহস্তে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। নৃসিংহদেব হিরণ্যকশিপুর শরীরটিকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন। তারপর হিরণ্যকশিপুর মৃত্যু হলে নৃসিংহদেরব আহ্বান করলেন এবার কে আছো এসে যুদ্ধ করো। অসুররা সবাই তখন ভয়ে পালালো। দেবতারা ভগবান নৃসিংহদেবের পূজা ও বন্দনা করতে লাগলেন। প্রহ্লাদ এসে নৃসিংহদেবকে একটি ফুলের মালা প্রদান করলেন।

বিভিন্ন কল্পে ভগবান নৃসিংহদেব বিভিন্ন রকমের লীলাবিলাস করে আবির্ভূত হয়ে থাকেন। এ কল্পে স্তম্ভ থেকে আবির্ভূত হন, অন্য কল্পে অন্য রকম। আজকাল এ সমস্ত ঘটনা নিয়ে আমরা সমালোচনা করতে পারি। যেমন হিরণ্যকশিপুর পূজার ঘর এত বিশাল কি করে হবে? কিন্তু এখন অল্পশক্তি সম্পন্ন মানুষ এক একটি স্টেডিয়াম করছে। স্টেডিয়াম করতে আবার কোথাও কোথাও নিষেধ করা হচ্ছে। এক একটি স্টেডিয়ামে পঞ্চাশ থেকে একশো হাজার লোক থাকে। আর, হিরণ্যকশিপু জগতের সমস্ত শক্তি অর্জন করেছিলেন। সমস্ত দেবতাকে তিনি জয় করেছিলেন। ইন্দ্রশক্তি, অগ্নিশক্তি, বায়ুশক্তি, বরুনশক্তি সমস্তই তার কারায়ত্ত। তা হলে তাঁর পক্ষে সুন্দর সজ্জিত বড় একটা স্টেডিয়াম করা এমন কিছু কঠিন নয়। আমাদের এই পৃথিবী একটি ছোট গৃহ। এর তুলনায় অন্যান্য গ্রহগুলি অনেক গুণ বড়। সব গ্রহগুলি হিরণ্যকশিপুর দখলে ছিল। সেই রকম ব্যক্তির পক্ষে একটা বড় ঘর বানানো কোনও আশ্চর্যের ব্যাপার নয়।

ভক্ত প্রহ্লাদ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস কখনও হারিয়ে ফেলেননি। তাঁর উপর কত অত্যাচার হল, তবুও তিনি নিশ্চল ছিলেন। আমাদের যদি ছোট খাটো কিছু হয় তবে আমাদের ভয় লেগে যায়, আমরা অনেক ক্ষেত্রেই বিচলিত হয়ে পড়ি। কিন্তু প্রহ্লাদ একবিন্দুও বিচলিত হননি। তাঁর দৃঢ় অটুট বিশ্বাস ছিল। তিনি নিরন্তর শ্রীহরি স্মরণ করতেন। শ্রীহরিনাম কীর্তন করতেন। এরকমই শিক্ষা।

হিরণ্যকশিপু সমগ্র জগৎ জয় করে ফেললেন। সমগ্র জগতের রাজা হলেন তবুও তিনি সুখী হননি। মনের তুষ্টি লাভ করতে পারেননি। এই জড় জগতে যে লাখপতি, সে ক্রোড়পতি হতে চায়, যে ক্রোড়পতি, সে দশক্রোড় পতি হতে চায়। কোন ব্যবসায়ীর হাজার ক্রোড়েরও উর্ধ্বে সম্পত্তি রয়েছে, তবুও সে খুশী হতে পারে না। জগৎটাই হিরণ্যকশিপুর মালিকানায় এল। তবুও সে খুশী নয়। পুত্র প্রহ্লাদ তার শরণাপন্ন হচ্ছে না দেখে তাঁকে মেরে ফেলতে চাইছে। হিরণ্যকশিপু ভাবছিলেন, আমার উপরে কোন আইন নেই। আমি যমরাজকে কারাগারে রেখে দিয়েছি, আমাকে নরকে যাতনাও পেতে হবে না। নরক আমারই সম্পত্তি। দেবতাদেরকে নরকে আটক রেখেছি। অতএব তার কতই না সুখ সুবিধা। তাতে খুশী থাকার তো কথা। কিন্তু না, হিরণ্যকশিপু খুশী হতে পারে নি। আমাদের মানবজীবনে এভাবে আসুরিক মনোবৃত্তি গ্রহণ করা উচিত নয়। ভগবানের প্রতি শ্রদ্ধভক্তি অনুশীলন করা উচিত। আমরা যদি শ্রীকৃষ্ণের সেবা করি, সেবাদায়িত্ব নিই, তবে ভক্তবৎসল কৃষ্ণও আমাদের দায়িত্ব নেবেন এবং আমাকে রক্ষা করবেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন