হেডলাইটের পেছনে ট্রেন আছে

 



এক জায়গায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, ‘অহং বীজপ্রদ পিতা–‘আমি সব কিছুর বীজ প্রদানকারীর পিতা।’ অনেক চিন্তাশীল ব্যক্তি আলোচনা করে, কি আগে হল– ডিম না মুরগি। এখানে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, “আমি সমস্ত বীজের স্বরূপ” অর্থাৎ বীজটা আগে হল এবং বীজ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ থেকে সব কিছুর উৎপত্তি হয়েছে। (গীতা ১৪/৪)

‘স্থাবর’ মানে যে সব জীব অচল, যেমন গাছ; ‘জঙ্গম’ হল কীট, পতঙ্গ-পাখি– যারা চলে। সব কিছু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ থেকে আসছে। এই থেকে আমরা বুঝতে পারি আমরা সবাই শ্রীকৃষ্ণের সন্তান।

অনেকে মনে করেন তিনি নিরাকার এবং নিরাকার ব্রহ্ম হচ্ছে মূল কারণ। নিরাকার ব্রহ্ম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একটি স্বরূপ, তাঁর নিজের অঙ্গের জ্যোতি। গীতার ১৪শ অধ্যায়ে তিনি বলেছেন, “আমি নির্বিশেষ ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা বা আশ্রয়।” অনেকে মনে করেন, ‘এই জগতের আকার আছে, পরম ব্রহ্ম তো নিরাকার– এই সোজা ব্যাপারে বিবাদ কিসের?’ কিন্তু দিন সাদা, রাত কালো– এ তো জড় বুদ্ধি। সাদা, কালো, দিন, রাত– এইগুলি বিষয়বস্তু। এইভাবে অনুবাদ করে পরম ব্রহ্মকে বোঝা যায় না। পরম ব্রহ্ম বুঝতে হলে তাঁর কাছে থেকেই জানতে হবে। গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেছেন– আমি কে।

একটা উদাহরণ আছে– একজন গ্রাম থেকে এসেছে, জীবনে প্রথম রেল লাইন দেখছে। সবাই বলেছে, লাইনের কাছে দাঁড়ালে ট্রেন দেখা যাবে। ট্রেন কি রকম দেখতে তার কোনও ধারণা নেই। দেখতে দেখতে রাত হয়ে গেল, ট্রেন নেই। তখন অনেক দূরে ট্রেনের সামনে যে বাতি থাকে সেটা দেখা গেল। তা দেখে একজন বলে উঠল, আরে আমি ট্রেন দেখেছি। লোকে যখন জিজ্ঞাসা করল, কি দেখেছ, সে বলল, ট্রেন একট লাইট, জ্যোতি।

আর একজন ইঞ্জিন দেখেছে, সে বলল, তার দু’দিকে ধোঁয়া, পীপ্ পীপ্ শব্দ আর চারদিকে ধুলোবালি– এই বলে ‘আমি ট্রেন দেখেছি, ট্রেন দেখেছি’ চিৎকার করতে করতে বাড়ি ফিরে গেল। যে দেখেনি সে জানল, ট্রেনের একটা রূপ আছে– কালো, লোহার আর চারিদিকে ধুলো বালি ছড়িয়ে থাকে।

কিন্তু আর একজন সেইখানে দাঁড়িয়ে থেকে দেখল ট্রেন স্টেশনে থামল। ড্রাইভার, টিকিট চেকার, অনেক যাত্রী, সেখানে মুড়ি বেচা হয় ইত্যাদি। তারপর ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে যায়– তাও দেখল।

এই জীবন থেকে চলে গেলে প্রথমে ব্রহ্মজ্যোতি দর্শন হয়, মনে হবে পরম ব্রহ্ম দেখেছি। ঠিক যেমন ট্রেনের বাতি দেখা লোকটি বাড়ি ফিরে গেল। কিন্তু দ্বিতীয় জন ধৈর্য ধরে দেখেছে জ্যোতি কোথা থেকে আসছে; যোগীরা জানে পরমব্রহ্মের পরমাত্মা রূপ থেকে রশ্মিচ্ছটা বিকিরণ হয়, তবে রূপটা জানে না। কিন্তু ভক্তিযোগী হচ্ছেন তৃতীয় ব্যক্তিটির মতো– সে ট্রেন, ইঞ্জিন, যাত্রী সমস্ত কিছু দেখেছে, ভক্তিযোগী গোলোক বৃন্দাবনে যায়, সেখানে দেখে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, রাধারাণী, অষ্টসখী, মা যশোদা, নন্দ মহারাজ, গোপজন, গিরি গোবর্ধন– সব কিছু আছে। শ্রীকৃষ্ণ একলা নেই। ভক্তিযোগী উপলব্ধি পায় যে, ভগবান আনন্দময়, বহু পার্ষদ নিয়ে থাকেন।

এখন প্রথম জন ঠিকই ধরেছে– ট্রেনের একটা বাতি তো থাকেই, কিন্তু যারা মনে করছে বাতিই সব কিছু… বাতিটা একটা অংশমাত্র। তেমনই, যে মাত্র ইঞ্চিনের রূপ দেখল– সেও মিথ্যা নয়; আংশিক একটা উপলব্ধি। কিন্তু ভক্তিযোগীর পূর্ণ উপলব্ধি আছে।

যারা নিরাকারবাদী, তারা বুঝতে পারে না, ভক্ত কেন এভাবে ভগবানকে পূজা করে, ভক্তি করে। তারা অনুমান করে যে, সব কিছু শূণ্য। কিন্তু আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এমন কিছু আছে কি, যা শূণ্য থেকে এসেছে? ‘কিছু নেই’ থেকে ‘কিছু’ হয় না। কি করে হবে? এটা অসম্ভব ব্যাপার। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সচ্চিদানন্দ গুণ সমন্বিত– এই হিসাবে তিনি নির্গুণ, জড় জাগতিক গুণ নেই, পারমার্থিক গুণ বিপুল আছে। সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের সকলের কারণ, আমরা তাঁর কাছ থেকে এসেছি। এই জন্য সকলের পক্ষে তাঁর সেবা করা, ভক্তি করা, পূজা করা স্বাভাবিক কর্তব্য থাকে।

গীতাতে এই কথাও বলা আছে, আমরা যদি ভগবানের অংশ হই, তবে আমাদের উচিত তাঁর সেবা করা– অংশ অংশীকে সেবা করবে। আমাদের হাত হচ্ছে আমাদের দেহের অংশ, হাত দেহকে সেবা করবে। হাত যদি কোনও কাজ না করে দেহের সাথে জুড়ে থাকে, তা হলে সে রোগী। আমরা যদি বলি ভগবানের সেবা করব না, নিজের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন, লালসাই করব, তা হলে আমরাও রোগী, অকাজী এবং তার ফলে আমাদের দুঃখ কষ্ট।

আমরা যদি ভগবানের সেবা করি তা হলে আমাদের স্বাভাবিক আনন্দ আস্বাদন হয়। তিনি আমাদের স্বরূপ। যত আচার্য, যত সম্প্রদায় সকলের পিতা তিনি। শঙ্করাচার্য, রামানুজাচার্য, মধ্বাচার্য, বিষ্ণুস্বামী, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু– সবাই গীতাকে মানেন। বেদের সার হচ্ছে গীতা; গীতার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন– “আমি সমস্ত বীজের স্বরূপ।”

অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের সখা আর শ্রীকৃষ্ণ হলেন পার্থসারথি। তিনি সমস্ত জীবের তারণ কর্তা, কিন্তু তাঁর বন্ধুর জন্য তিনি রথের সারথি হলেন। ভগবান পরম ঈশ্বর, তিনি বিশ্বরূপ দেখালেন অর্জুনের কাছে, কিন্তু ভালবাসা প্রেমের জন্য তাঁর ভক্তকে সেবা করছেন।

এই জন্য শ্রীকৃষ্ণকে অনেকে বুঝতে পারে না। একদিকে তিনি যদি ভক্তের দাসত্ব করতে পারেন, কি করে উনি পরমেশ্বর হবেন? এই হচ্ছে তাঁর মহত্ত্ব। যেমন বাবা ছেলের সেবা করেন। ভগবান ভক্তের ছেলে হতে পারেন, এই জন্য শ্রীকৃষ্ণ যশোদা এবং নন্দ মহারাজের নন্দন হলেন।

সর্ব ধর্ম স্বীকার করে যে, ভগবান হচ্ছেন পরম পিতা। গীতা তাও বলছেন কিন্তু তার ওপরেও গীতা বলছেন যে, ভগবান তাঁর ভক্তের জন্য পরম পিতা নন, তিনি ভক্তের অভিলাষ পূর্ণ করতে চান– বাবা সব সময়ে ছেলের সেবা করতে চান। অন্য কোনও ধর্মে কিন্তু এটা শোনা যায় না। এই জন্য এটা হচ্ছে পি-এইচ. ডি, ধর্ম। এখানে রহস্য আছে। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন অর্জুনের কাছে–“কতকগুলি রহস্য আমি তোমার কাছে বলছি, গুহ্যতত্ত্ব।”

ভগবান কি করে তাঁর ভক্তের অধীন হতে পারেন– ভালবাসা প্রেমের দ্বারা, এটা কি রহস্য। এটা সবার কাছে বিস্তারিত বলা যায় না। যারা হিংসা করে, যারা ভগবানকে মানে না, স্বীকার করেন না, ভগবানের কাছে যারা প্রণাম করবে না, ভক্তি করবে না, তাদের কাছে বললেও তারা কি বুঝবে? সরল যারা, তারা বুঝতে পারবে ভগবানের মাহাত্ম্য– যে, ইচ্ছা করলে ভক্তের অধীনে আসতে পারে– ভক্তবৎসল।

যত আমরা ভগবানের কথা শ্রবণ করি, মনে হয় এই রকম প্রভুর কেন সেবা করব না? এত দয়াময়, এত কৃপালু, কেন কেউ তাঁর আশ্রয় নেবে না? এই জগতে আমরা সবাই চেষ্টা করছি প্রভু হতে। সবাই চায় যে, সবাই তার সেবা করুক, যেন দাস হওয়া মানে ঘৃণার ব্যাপার। ভগবানের অন্তরঙ্গ সেবক হতে পারলে এর থেকে আর বড় জিনিস নেই। তাই তাঁর দাস হওয়ার অনুশীলনে পি-এইচ.ডি. লাভ করা যায়– হেডলাইট দেখার পরও তার পেছনে যে ট্রেন আছে, তার যাত্রী, ড্রাইভার, চেকার, স্টেশন ইত্যাদি সব কিছু সম্বন্ধে জানা হয়ে যায়। এই জন্য শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সকলের কাছে কৃষ্ণপ্রেম বিতরণ করলেন, কৃষ্ণভক্তি অনুশীলন করতে আদেশ দিলেন। সবাই যেন কৃষ্ণনাম করে তার জীবন ধন্য করে তোলে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন