পুণ্য সংগ্রহের মাস–মাঘ মাস

 অশুভ কর্মফল থেকে মুক্ত হয়ে কৃষ্ণভাবনায় অগ্রসর হওয়ার জন্য নানা সুযোগ ভগবান তাঁর আশীর্বাদস্বরূপ আমাদের দিয়ে থাকেন। বছরে সেই রকম একটি সময় হল মকর সংক্রান্তির শুরুতে–মাঘ মাস।



তিনটি মাস বিশেষ মাহাত্ম্যপূর্ণ। যেমন বৈশাখ মাস হল বিষ্ণুর উপাসনার জন্য বিশেষ উপযুক্ত সময়। এই সময়ে থাকে নৃসিংহ চতুর্দশী, চন্দন যাত্রা ইত্যাদি নানা পূজাপর্ব। তরপর আসে কার্তিক মাস বা দামোদর মাস, যখন আমরা পূজাদি সহ কিছু কৃচ্ছ্রসাধন আয়ত্ত করি এবং বিশেষ কোনও কোনও খাদ্য বর্জন করে চলি।

আর তৃতীয় মাস হল মাঘ মাস–যখন ভক্তরা ভগবানের আরাধনা করে তাঁকে পুষ্পাদি নিবেদন করে থাকে। শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃতে মাঘ মাসকে শ্রীমাধব বলা হয়েছে। কথিত আছে–“যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পুণ্য দেশ”। অর্থাৎ, মাঘ মাসের শেষে বৃষ্টি হলে সেটা খুবই শুভ লক্ষণযুক্ত। মাঘ মাসের শুক্ল পক্ষে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। গৌর পূর্ণিমার সময়ে তিনি পৃথিবীতে প্রকটিত হন, কিন্তু এই পুণ্য মাঘ মাসেই তিনি তাঁর পিতামতার শরীরে প্রবেশ করেন এবং তেরো মাস পরে ফাল্গুন মাসে তিনি ধরাধামে আবির্ভূত হন।

‘ভক্তিরসামৃতসিন্ধু’ গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায়ে উল্লেখ আছে যে, পদ্মপুরাণের একটি উল্লেখযোগ্য শ্লোকে মহর্ষি বশিষ্ট রাজা দিলীপকে বলেছেন, “হে রাজন্, মাঘ মাসের সকালে স্নান করার অধিকার যেমন সকলেরই রয়েছে, ঠিক তেমনই ভগবদ্ভক্তি অনুশীলন করার অধিকার সকলেরই আছে”। পদ্মপুরাণের এই কাহিনীতে বর্ণিত রাজা দিলীপ কোনও সাধারণ রাজা ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমগ্র পৃথিবীর সম্রাট। একবার তিনি উপুুযুক্ত পোশাকাদি পরে বনে গিয়েছিলেন শিকার করতে। শিকারের সমস্ত সরঞ্জাম, ধনুক, তরোয়াল, সাঙ্গপাঙ্গ, ঘোড়া ইত্যাদি নিয়ে তিনি যাত্রা করেন। ক্ষত্রিয়দের যুদ্ধ করাই ধর্ম। কিন্তু শান্তির সময়ে, যখন যুদ্ধ থাকে না, তখন বনে গিয়ে শিকার করার অনুমতি তাদের দেওয়াই আছে।

সেবার এক লোভনীয় জন্তুর পেছনে ধাওয়া করতে করতে রাজা দিলীপ গভীর অরণ্যে ঢুকে পথ হারিয়ে ফেলেন। বহুক্ষণ ঘোরাঘুরি করতে করতে রাত ভোর হয়ে যায় এবং তৃষ্ণার্ত, শ্রান্ত হয়ে রাজা সুন্দর এক পদ্মদলশোভিত, পাখিদের গুঞ্জনমুখরিত বিশাল জলাশয়ের কাছে পৌছান। সেখানে সরিত মুনি ধ্যানমগ্ন ছিলেন। শীর্ণকায় তাঁর দেহ; তিনি নিরন্তর ভগবান বিষ্ণুর নাম কীর্তন করে চলেছিলেন। রাজা তাঁকে দর্শন করামাত্র শ্রদ্ধাভরে প্রণতি নিবেদন করেন। রাজাকে পরিশ্রান্ত দেহে ধূলিময় বস্ত্রদিতে দেখে মুনি মন্তব্য করেন–এই পুণ্য মাঘ মাসের প্রাতে তুমি এখনও স্নান সম্পন্ন করনি! রাজা কৌতুহল বশত জানতে চান এমন আবশ্যকীয় স্নানের তাৎপর্য কি? এবং মুনির নির্দেশ অনুযায়ী রাজা বশিষ্ঠ মুনির কাছে যান পূর্ণাঙ্গ উত্তর পেতে। তিনি বলেন, বৈশাখ, কার্তিক ও মাঘ– এই তিন পুণ্য মাস অতিক্রান্ত হয়ে বসন্ত থেকে ক্রমে শীত ঋতু আগত হয়। পুণ্যপ্রাথী এই সময়ে বহু পূণ্য লাভ করতে পারে, তার সমস্ত পাপ ধৌত হয়। তবে সমস্ত পক্রিয়াটাই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টিবিধানের উদ্দেশ্যে পালিত হওয়া উচিত।

হিমালয়ের মনিকূট পাহাড়ের ফল, ফুল, বনস্পতি সহ প্রাকৃতিক সম্পদের বিপুল শোভা বিলাসের মাঝে আবিষ্ট ভৃগু মুনির কাছে এক বিদ্যাধর-দম্পতি আসে। এবং কোনও কারনে তারা যে পারমার্থিক দিক দিয়ে উদ্বিগ্ন, তা প্রকাশ করে। ভৃগু মুনি বলেন, পুরো মাঘ মাসটা দিনে তিনবার স্নান করবে, বিশেষ করে সকালে। এইভাবে, চাঁদ যেমন কমতে কমতে একাদশী দশা প্রাপ্ত হয় এবং বৃদ্ধি পেতে পেতে পূর্ণিমাতে ষোল কলা পূর্ণ হয়, তেমনি তোমার পাপ হ্রাস পাবে এবং পূণ্য বৃদ্ধি পাবে।

আরও কাহিনী আছে যেখানে বর্নিত হয়েছে চম্পক ফুলের দ্বারা পূজিত হলে বিষ্ণু কত খুশি হন। এক দুরাচারী রাজা ছিল, সে ছিল পাপী, শুচিক্রিয়া করত না, নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করত, বাছ বিচার বিহীনভাবে ইন্দ্রিয়তৃপ্তিতে মগ্ন হত, লোক ঠকাতো, ঘুষ নিত– মোটের ওপর সে এক অযোগ্য শাসক ছিল। প্রজারা তার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল, ফলে এক বিদ্রোহী দল গড়ে উঠল রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করবে বলে।

এই চারিত্রিক ইতিহাস যার, সেই রাজা একবার যায় তার এক বেশ্যা-বান্ধবীর সাথে দেখা করতে। মাহিলাটি তার বাগানে এক চম্পক গাছের নিচে সুন্দর করে সাজানো বসার জায়গায় অপেক্ষা করে ছিল। কোনভাবে বিদ্রোহীরা এই সংবাদ পায় এবং তারা এই বাগানবাড়িটি ঘিরে ফেলে এবং সুযোগের ওৎ পেতে থাকে।

রাজা যখন গল্প করছিল, গাছ থেকে একটি চম্পক ফুল ঝরে পড়ে। এবং সেই মুহূর্তে রাজা বলে ওঠে “মুরারি পুষ্পক নারায়ণায় নমঃ”। ঠিক যেমন একটা গল্পে আছে– এক ফেরিওলা ঝুড়িতে করে খই নিয়ে যাচ্ছিল। এক দম্কা হাওয়ায় সব খই উড়ে যায়। খইগুলো যখন বাতাসে রয়েছে, লোকটি চেঁচিয়ে বলে নিল, “উড়ো খই গোবিন্দায় নমো”। অর্থাৎ মাটিতে যতক্ষণ না পড়ছে ততক্ষণ অবধি শুদ্ধ আছে, বিক্রির  লাভ যখন হলই না, শুদ্ধ থাকতে থাকতে গোবিন্দকে নিবেদনে লাভটুকু পেয়ে নেওয়া যাক। যখন সেটা কোনও কাজেই লাগছে না, তখন আমরা তা কৃষ্ণকে দিয়ে দিই। ‘কিছু না’-এর থেকে তা-ই ভাল।

রাজা যেইমাত্র বলেছে, ‘নারায়ণ, এই ফুলটি তোমার উদ্দেশ্যে দিলাম’, ঠিক সেই মুহূর্তে বিদ্রোহীরা শোঁ করে একটা তীর ছুঁড়ল এবং তা গিয়ে বিঁধল সোজা রাজার বুকে। তৎক্ষণাৎ মৃত্যুকোলে ঢলে পড়ল রাজা। যমদূতেরা তাকে নিতে এল, কারণ সে ছিল পুরোপুরি অধার্মিক পাপাচারী নরাধম। বিষ্ণুদূতেরাও এল, তারা বলল, ‘ঠিক কথা, কিন্তু মৃত্যুকালে ওর শেষ কথা ছিল বিষ্ণুর নাম। এই পুণ্য মাঘ মাসে সে বিষ্ণুকে একটি পুষ্প অর্পণ করেছে এবং বিষ্ণুর নাম উচ্চারণ করে দেহ ত্যাগ করেছে’ যমদূতেরা প্রতিবাদ করে বলল, ‘ও তো নিষ্ঠার সাথে কিছু করেনি।’

বিষ্ণুদূতেরা সেই কথায় কর্ণপাত না করে রাজার আত্মাকে নিয়ে বৈকুন্ঠে বিষ্ণুলোকে চলে গেল। সেখানে ভগবান বিষ্ণু দু’বাহু প্রসারিত করে, ‘আমার প্রিয় ভক্ত, এস’ বলে রাজাকে অভিনন্দন জানালেন। রাজা ভাবছে, ‘আমি? ভক্ত?’ বিনয়ের সাথে বলল, ‘আমি এত শুদ্ধ হতে পারলাম কই?’ বিষ্ণু বললেন, না, না তুমি আমায় আমার প্রিয় চম্পক ফুল অর্পণ করেছ। পুণ্য মাঘ মাসে যে এই কাজ করে, আমার কাছে আসার পথ তার কাছে অতি সহজ হয়ে যায়। তারপর মৃত্যুকালে তোমার মুখের  শেষ কথা ছিল আমারই নাম। অন্তিম মুহূর্তে যে আমার নাম নিতে পারে সেও আমাকেই প্রাপ্ত হয়।’

রাজা বুঝল, ভগবান বড়ই করুণাময়। যদিও আমি যোগ্য নই, তবু সুযোগ তো একটা পেয়েছি। এই ভেবে সে সম্পর্ণ আত্মসমর্পণ করল। হৃদয়ে সে এক পরিপূর্ণ পরিবর্তন অনুভব করল। ফলে ভগবান তাকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলেন এবং সে সম্পূর্ণ শুদ্ধতা অর্জন করল।

সুতরাং এই মাঘ মাসে সামান্য একটা ফুল নিবেদনেরও কত বিশাল পাওনা থাকে। তাই এটি একটি বিশেষ মাস।

তবে ভক্তরা নিত্যের খদ্দের। তারা সব মাসেই ভগবানের কৃপা লাভ করে থাকে। অতএব এটি হল নবাগতদের আকৃষ্ট করার একটি পন্থা। প্রকৃতপক্ষে, ভক্তরা সব রকম আচার-অনুষ্ঠানই সব মাসে করে থাকে– এবং তারা তা করে শুধুমাত্র শ্রীকৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্য নিয়ে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন