কৃষ্ণের কৃপা আসে গুরুদেবের মাধ্যমে

 



আচার্যং মাং বিজানীয়ান্ নাবমন্যেত কর্হিচিৎ

ন মর্ত্যবুদ্ধাসূয়েত সর্বদেবময়ো গুরুঃ ॥

“আচার্যকে আমার থেকে অভিন্ন বলে মনে করা উচিত এবং কখনও কোনভাবে তাঁকে অশ্রদ্ধা করা উচিত নয়। তাঁকে একজন সাধারণ মানুষ বলে মনে করে তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত হওয়া উচিত নয়, কেননা তাঁর মধ্যে সমস্ত দেবতার অধিষ্ঠান আছে।” (ভাগবত ১১/১৭/২৭)

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অন্তরঙ্গ সখা উদ্ধবকে এই কথা বলেছেন। শ্রীল প্রভুপাদ বিভিন্ন জায়গায় এই শ্লোকের ব্যাখ্যা করেছেন। সমাজের চার বর্ণের চার আশ্রমের মানুষদের কিভাবে চলা উচিত সেই সম্বন্ধে উদ্ধব জানতে চেয়েছিলেন। কৃষ্ণ বলেছিলেন, ব্রহ্মচারীরা শ্রীগুরুদেবের আশ্রয়ে থেকে গুরুদেবের প্রতি শ্রদ্ধা রাখবে এবং সেবানিষ্ঠা পরায়ন হবে। গুরুদেব শিষ্যের কাছ থেকে শুধু সেবা পেতে থাকবেন বা ভোগ করে যাবেন– তা নয়। তিনি একজন পিতার মতো। পিতা ছোট ছেলেদের মানুষ করে গড়ে তোলেন, যত্ন নেন। আধ্যাত্মিক জগতে গুরুদেবও শিষ্যদের প্রতি সেই রকম। গুরুদেব পারমার্থিক বিষয়ে অবগত থাকেন।

মনুসংহিতায় আচার্যের কর্তব্য নির্ধারিত হয়েছে। আচার্য বা গুরুদেব অবশ্যই পরম্পরার ধারায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। আচার্য অন্যদের দ্বিজত্ব দান করে থাকেন। গুরুদেব যখন দীক্ষা দেন তাকে বলা হয় উপনয়ন, যার মাধ্যমে কেউ একজন শ্রীগুরুদেবের সন্নিকটে আসতে পারেন। যতক্ষণ পর্যন্ত পৈতা বা উপবীত ধারণ মাধ্যমে গুরুদেবের কাছে না আসছে ততক্ষণ শূদ্রস্তরে সে থেকে যায়।

উপনয়ন সংস্কারের মাধ্যমে শিষ্য গুরুদেবের কাছে উপবীত পেয়ে থাকেন। বেদের জ্ঞান লাভ হয়ে থাকে গুরুদেবের কাছ থেকে। গুরুদেবই নিত্য শিক্ষা দান করেন। কেউ জন্মগত ক্ষেত্রে শূদ্র থাকলেও শাস্ত্রানুমোদিত সংস্কারের মাধ্যমে দিজত্ব লাভ করে সেবা অধিকার পেয়ে থাকে। বায়ুপুরানে বলা হয়েছে, যিনি বৈদিক সিদ্ধান্তে নিপুণ, যিনি বেদের নিয়ম পালন করেন এবং শিষ্যদের শিক্ষা দেন তিনি আচার্য। তাঁর কাজ হচ্ছে ভগবানের অপ্রাকৃত ভক্তিমূলক সেবায় তিনি সর্বদা নিয়োজিত থাকবেন। তিনি ভগবানের চরণে আত্মসমর্পিত প্রাণ। যাঁরা নিজেকে আচার্য বলেছেন, ভগবানের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন না, তাঁরা অপরাধী বলে বিবেচিত হন। অপরাধ আচার্যের পদ থেকে বিচ্যুত করে দেয়।

পরম্পরার আচার্যগণ সর্বদা শুদ্ধভক্তি সেবায় রত থাকেন। আচার্য হচ্ছেন শ্রীমন্ নিত্যানন্দ প্রভুর সাক্ষাৎ প্রতিনিধি স্বরূপ। আচার্য কখনও তাঁর ইন্দ্রিয় বেগ দ্বারা প্রভাবিত হন না। জড় জাগতিক পরিস্থিতি থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে। সেইজন্য আচার্যকে ভগবানের অভিন্ন স্বরূপ বলা হয়েছে। তিনি সর্বদা অপ্রাকৃত স্তরে স্থিত থাকেন।

শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, আচার্য ভগবানের প্রতিনিধি। তিনি কৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয়। গুরুদেব স্বয়ং কৃষ্ণ নন। কোনও কোনও মায়াবাদী বলে থাকে যে, গুরুদেব হচ্ছেন স্বয়ং কৃষ্ণ– এটা সাধারণ মানুষদের প্রতারণা করা হয়। বৈষ্ণবগণ বলেন, গুরুদেব হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয় সেবক। কিন্তু সাক্ষাৎ ভগবান নন। জগন্নাথপুরীতে এক প্রতারক নিজেকেই জগন্নাথ বলে জাহির করেছিল। মেয়েরা তাকে ভোগ নিবেদন করত। এক সময় সে মহিলাদের সঙ্গে নৃত্য করেছিল। এক মহিলা তার প্রতিবাদ করেছিল। তাকে মাছ নিবেদন করা হয়েছিল। সে মাছও খেত। মহিলাটির স্বামী পুলিশকে জানিয়ে ছিল। গোয়েন্দা পুলিশ তাকে লক্ষ্য করছিল। তাকে প্রতারক বুঝতে পেরে জেলবন্দী করা হয়েছিল।

গুরুদেব হচ্ছেন ভগবানের অন্তরঙ্গ প্রতিনিধি ভগবানের কৃপার মূর্তি। ভগবানের অল্প কিছু শক্তি গুরুদেবের মধ্যে আছে, তাই তাঁকে শ্রদ্ধা করা হয়। শ্রীল প্রভুপাদ সেই রকম মূর্ত বিগ্রহ। বোস্টন শহরে যখন শ্রীল প্রভপাদকে তাঁর শিষ্য ও অনুগামীরা পূজা অভ্যর্থনা করছিল, একে একে সারি করে দাঁড়িয়ে পর পর তাঁকে মালা পরাচ্ছিল এবং টিভিতে তা দেখানো হয়েছিল। তখন অনেকের মনে প্রশ্ন ছিল। কে এই লোকটি? কেন ওঁকে এভাবে পূজা করা হচ্ছে? উনি কি ভগবান?

পরে তারা বুঝতে পারল যে, শিষ্যদের কর্তব্য হচ্ছে গুরুদেবকে ভগবানের প্রতিনিধি জ্ঞানে পূজা করা। প্রভুপাদ দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, গুরু যদি মনে করেন যে তিনি হচ্ছেন ভগবান– তা হলে তিনি ভগবান নন, তিনি মোটেই God নন, তিনি হচ্ছেন গডের বিপরীত Dog।

কলিযুগে বৈদিক সংস্কৃতির অভাব। তাই কে ভগবান– সে সম্বন্ধে মানুষের ধারনাই নেই। মানুষ যাকে-তাকেই ভগবান বলে মনে করছে। গুরুদেব প্রকৃত পারমার্থিক জ্ঞান দান করেন কিভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করতে হয়। তিনি অন্তরঙ্গ সেবক। তাই তিনি অভিজ্ঞ। তিনি ভক্তিসেবার মূর্ত রূপ।

ভগবানকে সেবা করতে হয় গুরুদবের মাধ্যমে। আমরা সরাসরি ভগবানের সেবা করতে পারি না। কখনও নিজেকে মনে করা উচিত নয় যে, আমি শুদ্ধ হয়ে গেছি, আমি উপযুক্ত। গুরুদেব ভগবানকে ভোগ নিবেদন করেন গুরু পরম্পরার মাধ্যমে। শেষে রাধারাণী, তারপর কৃষ্ণের কাছে– এভাবে সেবা পৌছায়। আবার ভগবানের প্রসাদ বা কৃপা রাধারাণী থেকে শুরু করে পরম্পরা হয়ে গুরুদেব পর্যন্ত আসে। তারপর আমাদের কাছে পৌঁছায়। এভবে আমরা মহামহা প্রসাদ পেয়ে থাকি। পরম্পরা বাদ দিয়ে আমরা ভগবানের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারি না।

শ্রীল প্রভুপাদ আমাদের জীবন। তিনি ইসকন পরিচালনার মুখ্য শিক্ষক। কোন কোন সময় কেউ হয়তো গাইডেন্স্ পাচ্ছে না। অনেকে শ্রীল প্রভুপাদের শিক্ষা নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করছে। কিন্তু প্রভুপাদের শিক্ষা অপরিবর্তনীয়। জি.বি.সি আমাদের সেই শিক্ষানুসারে গাইডেনস্ দিয়ে থাকেন। অনেকের ব্যক্তিগতভাবে সমস্যা থাকে।

দুটি নির্দশ বা পথ আছে। বানর ছানা তার মাকে আঁকারিয়ে ধরে থাকে। বিড়াল ছানাকে তার মা ধরে থাকে। এই দুটি পন্থার মধ্যে কোনটি দরকার? দুটোই দরকার। কৃষ্ণের নাম করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কৃষ্ণের কাছে যেতে হলে কৃষ্ণনাম ধরে থাকতে হবে। তা হলে কৃষ্ণ কৃপা করবেন। এমন নয় যে, এখনই কৃপা লাগবে, কৃষ্ণ কুপা করবেন, আর আমাদের নিজেদের কিছু কাজ নেই, করব না কিছুই। না এরকম ঠিক নয়। কে কতটা পারমার্থিক গুরুদেবকে ধরে রাখছে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। গুরুদেবকে ধরে থাকতে হবে এবং গুরুদেব আমাকে ছাড়বেন না। দুটোরই সমন্বয় আমাদের রাখতে হবে।

কুঁয়োতে একজন পড়ে আছে। অন্যজন দড়ির একটি প্রান্ত কুয়োর মধ্যে ফেলল। পতিত ব্যক্তিকে দড়িটি ভাল করে ধরে থাকতে হবে। যে দড়ি ফেলল সে সেই দড়িটা উপরের দিকে আকর্ষণ করতে থাকবে। তাহলে পতিত উদ্ধার হবে। গুরুকৃপা লাগবে আবার সেই কৃপা ধরার জন্য প্রয়াসী থাকতে হবে। তা হলে উদ্ধার পাওয়া যাবে।

কেউ কেউ বলে থাকেন, ‘আমি তো শুদ্ধ ভক্ত নই। তাই আমি চেষ্টা করতে পারছি না।’ না, চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে। এমন কি শুদ্ধ ভক্ত না হলেও কৃপালাভের চেষ্টা করতেই হবে। আমাদের অনেক কিছু সমস্যা থাকতেই পারে। কিন্তু আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি গুরুকৃষ্ণের কৃপা লাভের জন্য, সেই আমাদের চেষ্টা কিরকম সেটাই কৃষ্ণ দেখবেন।

বিড়াল ছানা মনে করে, মা আমাকে তুলে নেবে, আমি কেবল চুপচাপ থাকব– এরকম পন্থা, কিংবা বানর ছানার মতো মাকে ধরে থাকতে হয়, তাই ধরে থাকব, আর কোনও কৃপা লাগবে না– এ দুটো পন্থাই অসম্পূর্ণ।

কৃষ্ণভাবনামৃতে সমস্ত বৈষ্ণব নিজেরা আচরণ করে আমাদের শিক্ষা দিয়ে থাকেন। সকল বৈষ্ণবই আমাদের গুরু। গুরুর মধ্যে দীক্ষাগুরু ও শিক্ষাগুরু বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা আমাদের ভগবানের কাছে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। দীক্ষাগুরুর সংস্পর্শ না পেলে শিক্ষাগুরুই আমাদের উদ্ধার পাওয়ার পন্থার নির্দেশ দেন।

কৃষ্ণ গুরু পাঠাচ্ছেন আমাদের জন্য, আর আমরা বলছি না না, এমন নয়,  আমার গুরু গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই। এটাই হচ্ছে বৃথা অহংকার। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছে গুরুদেব কৃষ্ণের প্রেষ্ঠ জন। তাঁর মূল পরিচয়– তিনি কৃষ্ণসেবক। যার মধ্যে গুরুকৃষ্ণের সেবা মনোভাব নেই, সে কখনও গুরু হতে পারে না। সেই ব্যক্তি কখনও জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধিময় জীবন চক্র থেকে কাউকে উদ্ধার করতে পারে না।

গুরু পরমাত্মা নন, কে কি করছে দেখতে পাবেন। গুরু স্বয়ং নারদমুনি নন যে, চট্ করে কারও সমস্যা বুঝতে পারেন। তবে গুরুদেবের শাস্ত্রচক্ষু রয়েছে।

দেখা যায়, কেউ এমনভাব করছে, তার যেন অনেক সমস্যা। তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘তোমার কি সমস্যা?’ সে বলে, ‘গুরুমহারাজ, আমার সমস্যার কথা কি বলব, আপনি খুব ব্যস্ত।’ ডাক্তারের কাছে অবশ্যই রোগীকে তার রোগের কথা বলতে হবে। মায়ার ফাঁদে পড়ার আগে গুরুদেবের কাছে সমস্যা বিষয়টি বলতে হবে। রোগ জটিল হওয়ার আগেই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। সেটিই কর্তব্য।

মায়াতে পড়ার আগে গুরুদেবের শরণাগত হওয়া দরকার। সমস্যার কথা বলা দরকার। সমস্যায় পড়লে কোনও সংকোচ না করেই গুরুদেবের কাছে জানাতে হবে। কেননা গুরুদেব তার দায়িত্ব নিয়েছেন কৃষ্ণের কাছে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য । সে যদি মায়া সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ে থাকে, তা হলে গুরুদেবকেও ফিরে আসতে হয় তাকে নেওয়ার জন্য। শিষ্যের কর্তব্য নয়, গুরুদেবকে তার জন্য আবার বিব্রত করা।

আমরা কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের সকলে এক পরিবার ভুক্ত। একজন অসুস্থ হলে অন্যেরা তাকে সুস্থ হতে সাহায্য করবে। লোকদেরকে মায়া থেকে উদ্ধার করতে হবে। কৃষ্ণভাবনামৃত দান করতে হবে। সেটিই আমাদের প্রধান কাজ। মানুষ একে একে কৃষ্ণচেতনায় উদ্ধুদ্ধ হলে সারা পৃথিবী পরিবর্তন হয়ে যাবে। আনন্দময় হবে।

আত্মত্যাগ করার মনোভাব রাখতে হবে। একজনকে উদ্ধার করবার জন্য ১০০ পাউন্ড রক্ত যদি দিতে হয়, সেজন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। অপ্রাকৃত রক্ত। আমাদের শরীরে অপ্রাকৃত রক্ত কত আছে?

নেপালে এক সময় একজন যোদ্ধা যুদ্ধ করতে গিয়ে তার পেটের ভেতরে নাড়িগুলি বেরিয়ে গিয়েছিল। সে সেই নাড়িগুলি পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে কাপড় দিয়ে পেট বেঁধে আবার যুদ্ধ করছিল। এটি ক্ষত্রিয়দের শৌর্যবীর্য গুণ।

তা হলে পারমার্থিক জীবনের উন্নতি করতে হলে আমাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে। অনেক রক্ত দিতে হবে বদ্ধ জীবকে উদ্ধার করবার জন্য।

অনেক সময় শিষ্যরা কেউ কেউ বিভ্রান্ত হয়ে মনে করে, গুরুদেব আমাকে ভালবাসেন না। মা যেমন তার শিশুকে বলেন তোমাকে ভালবাসি না, কিন্তু মা অবশ্যই ভালোবাসেন। গুরুদেবও মায়ের মতো ভালোবাসেন। শ্রীগুরুদেবের শক্তি কৃষ্ণের কাছ থেকে আসে। অসীম কৃপাময় শ্রীকৃষ্ণের কৃপা গুরুদেবের মাধ্যমে জগতে নেমে আসে।

কৃষ্ণ সে তোমার কৃষ্ণ দিতে পার

তোমার শকতি আছে।

গুরু পরম্পরার মাধ্যমে কৃষ্ণপাদপদ্ম লাভ হয়ে থাকে। তাই আমাদের বিনীত হতে হবে। অপরাধমুক্ত থাকতে হবে। পূর্ববর্তী আচার্যদের উপর নির্ভর করে থাকতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন