শ্রীমদ্ভগবদগীতা অধ্যায়গুলোর সারমর্ম


 

প্রথম অধ্যায়- বিষাদ-যোগ
কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে সেনা-পর্যবেক্ষণ
রণাঙ্গনে প্রতীক্ষমাণ সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়ে, মহাযোদ্ধা অর্জুন উভয় পক্ষের সৈন্যসজ্জার মধ্যে সমবেত তাঁর অতি নিকট অন্তরঙ্গ আত্মীয়-পরিজন, আচার্যবগ ও বন্ধু-বান্ধবদের সকলকে যুদ্ধে প্রস্তুত হতে এবং জীবন বিসর্জনে উন্মুখ হয়ে থাকতে দেখেন। শোকে ও দুঃখে কাতর হয়ে অর্জুন শক্তিহীন হলেন, তাঁর মন মোহাচ্ছন্ন হল এবং তিনি যুদ্ধ করার সংকল্প পরিত্যাগ করেন।


দ্বিতীয় অধ্যায়- সাংখ্য-যোগ
গীতার বিষয়বস্তুর সারমর্ম পরিবেশিত
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে তাঁর শিষ্যরূপে অর্জুন আত্মসমর্পণ করেন এবং অনিত্য জড় দেহ ও শাশ্বত চিন্ময় আত্মার মূলগত পার্থক্য নির্ণয়ের মাধ্যমে অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ উপদেশ প্রদান করতে শুরু করেন। দেহান্তর প্রক্রিয়া, পরমেশ্বরের উদ্দেশ্যে নিঃস্বার্থ সেবার প্রকৃতি এবং আত্মজ্ঞানলব্ধ মানুষের বৈশিষ্ট্যাদি সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন।


তৃতীয় অধ্যায়- কর্মযোগ
কৃষ্ণভাবনাময় কর্তব্যকর্ম সম্পাদন
এই জড় জগতে প্রত্যেককেই কোনও ধরনের কাজে নিযুক্ত থাকতে হয়। কিন্তু কর্ম সকল মানুষকেই এই জগতের বন্ধনে আবদ্ধ করতেও পারে, আবার তা থেকে মুক্ত করে দিতেও পারে। স্বার্থচিন্তা, ব্যতিরেকে, পরমেশ্বরের সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে কাজের মাধ্যমে, মানুষ তার কাজের প্রতিক্রিয়া জনিত কর্মফলের বিধিনিয়ম থেকে মুক্তি পেতে পারে এবং আত্মতত্ত্ব ও পরমতত্ত্বের দিব্যজ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়।


চতুর্থ অধ্যায়- জ্ঞানযোগ
অপ্রাকৃত পারমার্থিক জ্ঞানের স্বরূপ উদ্ঘাটন
আত্মার চিন্ময় তত্ত্ব, ভগবৎ-তত্ত্ব এবং ভগবান ও আত্মার সম্পর্ক–এই সব অপ্রাকৃত তত্ত্বজ্ঞান বিশুদ্ধ ও মুক্তিপ্রদায়ী। এই প্রকার জ্ঞান হচ্ছে নিঃস্বার্থ ভক্তিমূলক কর্মের (কর্মযোগ) ফলস্বরূপ। পরমেশ্বর ভগবান গীতার সুদীর্ঘ ইতিহাস, জড় জগতে যুগে যুগে তাঁর অবতরণের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য এবং আত্মজ্ঞানলব্ধ গুরুর সান্নিধ্য লাভের আবশ্যকতা ব্যাখ্যা করেছেন।


পঞ্চম অধ্যায়- কর্মসন্ন্যাস-যোগ
কৃষ্ণভাবনাময় কর্তব্যকর্ম
বহির্বিচারে সকল কর্তব্যকর্ম সাধন করলেও সেগুলির কর্মফল পরিত্যাগ করার মাধ্যমে, জ্ঞানবান ব্যক্তি পারমার্থিক জ্ঞানতত্ত্বের অগ্নিস্পর্শে পরিশুদ্ধি লাভ করে থাকেন, ফলে শান্তি, নিরাসক্তি, সহনশীলতা, চিন্ময় অন্তদৃষ্টি এবং শুদ্ধ আনন্দ লাভ করেন।


ষষ্ঠ অধ্যায়- ধ্যানযোগ
নিয়মতান্ত্রিক ধ্যানচর্চার মাধ্যমে অষ্টাঙ্গযোগ অনুশীলন মন ও ইন্দ্রিয় আদি দমন করে এবং অন্তর্যামী পরমাত্মার চিন্তায় মনকে নিবিষ্ট রাখে। এই অনুশীলনের পরিণামে পরমেশ্বরের পূর্ণ ভাবনারূপ সমাধি অর্জিত হয়।


সপ্তম অধ্যায়- বিজ্ঞান যোগ
পরমতত্ত্বের বিশেষ জ্ঞান
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমতত্ত্বম সর্বকারনের পরম কারণ এবং জড় ও চিন্ময় সর্ববিষয়ের প্রাণশক্তি। উন্নত জীবাত্মাগণ ভক্তি ভরে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে থাকেন, পক্ষান্তরে অধার্মিক জীবাত্মারা অন্যান্য বিষয়ের ভজনায় তাদের মন বিক্ষিপ্ত করে থাকে।


অষ্টম অধ্যায়- অক্ষরব্রহ্ম যোগ
পরমতত্ত্ব লাভ
আজীবন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চিন্তার মাধ্যমে এবং বিশেষ করে মৃত্যুকালে তাঁকে স্মরণ করে, মানুষ জড়জগতের ঊর্ধ্বে ভগবানের পরম ধাম লাভ করতে পারে।


নবম অধ্যায়- রাজগুহ্য-যোগ
গূঢ়তম জ্ঞান
শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং পরমারাধ্য বিষয়। অপ্রাকৃত ভগবৎ-সেবার মাধ্যমে জীবাত্মা মাত্রই তাঁর সাথে নিত্য সম্বন্ধযুক্ত। মানুষের শুদ্ধ ভক্তি পুনরুজ্জীবিত করার ফলে শ্রীকৃষ্ণের পরম ধামে প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব।


দশম অধ্যায়- বিভূতি-যোগ
পরমব্রহ্মের ঐশ্বর্য
জড় জগতের বা চিন্ময় জগতের শৌর্য, শ্রী, আড়ম্বর, উৎকর্ষ–সমস্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় শ্রীকৃষ্ণের দিব্য শক্তি ও পরম ঐশ্বর্যাবলীর আংশিক প্রকাশ মাত্র অভিব্যক্ত হয়ে আছে। সর্বকারণের পরম কারণ, সর্ববিষয়ের আশ্রয় ও সারাতিসার রূপে শ্রীকৃষ্ণ সর্বজীবেরই পরমারাধ্য বিষয়।


একাদশ অধ্যায়- বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ অজুনকে দিব্যদৃষ্টি দান করেন এবং সর্বসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষক তার অনন্ত বিশ্বরূপ প্রকাশ করেন। এভাবেই তিনি তাঁর দিব্যতত্ত্ব অবিসংবাদিতভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। শ্রীকৃষ্ণ প্রতিপন্ন করেছেন যে, তাঁর স্বীয় অপরূপ সৌন্দর্যময় মানবরূপী আকৃতিই ভগবানের আদিরূপ। একমাত্র শুদ্ধ ভগবৎ-সেবার মাধ্যমেই মানুষ এই রূপের উপলব্ধি অর্জনে সক্ষম।


দ্বাদশ অধ্যায়- ভক্তিযোগ
চিন্ময় জগতের সর্বোত্তম প্রাপ্তি বিশুদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম লাভের পক্ষে ভক্তিযোগ বা শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে শুদ্ধ ভক্তি হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ উপযোগী পন্থা। যাঁরা এই পরম পন্থার বিকাশ সাধনে নিয়োজিত থাকেন, তাঁরা দিব্য গুণাবলীর অধিকারী হন।


ত্রয়োদশ অধ্যায়- প্রকৃতি-পুরুষ বিবেকযোগ
দেহ, আত্মা, এবং উভয়েরও ঊর্ধ্বে পরমাত্মার পার্থক্য যিনি উপলব্ধি করতে পারেন, তিনি এই জড় জগৎ থেকে মুক্তি লাভে সক্ষম হন।


চতুর্দশ অধ্যায়- গুণত্রয়-বিভাগ যোগ
জড়া প্রকৃতির ত্রিগুণ বৈশিষ্ট্য
সমস্ত দেহধারী জীবাত্মা মাত্রই সত্ত্ব, রজ ও তম–জড়া প্রকৃতির এই ত্রিগুণের নিয়ন্ত্রনাধীন। পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এই ত্রিগুণাবলীর স্বরূপ, আমাদের ওপর সেগুলির ক্রিয়াকলাপ, মানুষ কিভাবে সেগুলিকে অতিক্রম করে এবং যে-মানুষ অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত তার লক্ষণাবলী ব্যাখ্যা করেছেন।


পঞ্চদশ অধ্যায়- পুরুষোত্তম-যোগ
পরম পুরুষের যোগতত্ত্ব
বৈদিক জ্ঞানের চরম উদ্দেশ্য হচ্ছে জড়-জাগতিক বন্ধন থেকে মানুষের মুক্তি লাভ এবং পরম পুরুষোত্তম ভগবানরূপে শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করা। যে মানুষ শ্রীকৃষ্ণের পরম স্বরূপ উপলব্ধি করে, সে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং তাঁর ভক্তিমূলক সেবায় আত্মনিয়োগ করে।


ষোড়শ অধ্যায়- দৈবাসুর-সম্পদ-বিভাগযোগ
দৈব ও আসুরিক প্রকৃতিগুলির পরিচয়
যারা আসুরিক গুণগুলি অর্জন করে এবং শাস্ত্রবিধি অনুসরণ না করে যথেচ্ছভাবে জীবন যাপন করে থাকে, তারা হীনজন্ম ও ক্রমশ জাগতিক বন্ধনদশা লাভ করে। কিন্তু যাঁরা দিব্য গুণাবলীর অধিকারী এবং শাস্ত্রীয় অনুশাসন আদি মেনে বিধিবদ্ধ জীবন যাপন করে, তারা ক্রমান্বয়ে পারমার্থিক সিদ্ধিলাভ করে।


সপ্তদশ অধ্যায়
শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
জড়া প্রকৃতির ত্রিগুণাবলী থেকে উদ্ভুত এবং সেগুলির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শ্রদ্ধা তিন ধরনের হয়ে থাকে। যাদের শ্রদ্ধা রাজসিক ও তামসিক, তারা নিতান্তই অনিত্য জড়-জাগতিক ফল উৎপন্ন করে। পক্ষান্তরে শাস্ত্রীয় অনুশাসন আদি মতে অনুষ্ঠিত সত্ত্বগুণময় কার্যাবলী হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করে এবং পরিণামে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শুদ্ধ ভক্তি-শ্রদ্ধার পথে মানুষকে পরিচালিত করে ভক্তিভাবে জাগ্রত করে তোলে।


অষ্টাদশ অধ্যায়- মোক্ষযোগ
ত্যাগ সাধনার সার্থক উপলব্ধি
শ্রীকৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেছেন ত্যাগের অর্থ এবং মানুষের ভাবনা ও কার্যকলাপের উপর প্রকৃতির গুণাবলীর প্রতিক্রিয়াগুলি কেমন হয়। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন ব্রহ্ম উপলব্ধি, ভগবদ্গীতার মাহাত্ম ও গীতার চরম উপসংহার–ধর্মের সর্বোচ্চ পন্থা হচ্ছে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, যাঁর ফলে সর্বপাপ হতে মুক্তি লাভ হয়, সম্যক জ্ঞান-উপলব্ধি অর্জিত হয় এবং শ্রীকৃষ্ণের শাশ্বত চিন্ময় পরম ধামে প্রত্যাবর্তন করা যায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন